দালালের প্রতারণায় দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার পথে ৩ বাংলাদেশির মৃত্যু

জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৩৯ পিএম

দালাল চক্রের মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে একের পর এক বাংলাদেশি যুবকের প্রাণ যাচ্ছে আফ্রিকার পাহাড়-জঙ্গলে। নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে দক্ষিণ আফ্রিকা আসার পথে নাজমুল শিপু (২৫), আবেদ মিয়া (২০) এবং সাইফ উদ্দিন মো. রায়হান (২১) নামে তিন বাংলাদেশি যুবক জাম্বিয়ায় মারা গেছেন।
নিহত শিপু চাঁদপুর জেলার মতলব থানার বোয়ালিয়াবাড়ির বাসিন্দা। অপর নিহত আবেদ মিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর উপজেলার তালশাহার এলাকার বাসিন্দা।
সোমবার (২১ অক্টোবর) নাজমুল শিপু ও আবেদ মিয়া মারা গেছেন বলে নবীনগরের সেই দালাল নিহতদের পরিবারকে জানিয়েছে।
নিহতদের আত্মীয়দের মাধ্যমে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের বাবু ও কামরুজ্জামান দিপু নামে দুই দালালের সঙ্গে নাজমুল শিপু ও আবেদের পরিবারের সরাসরি ফ্লাইটে ভিসা করে দক্ষিণ আফ্রিকা পাঠানোর কথা চূড়ান্ত হয়। গত সপ্তাহে ঢাকার একটি ট্রাভেলসের মালিক পুলকের কাছে নিয়ে এসে ইথিওপিয়া পর্যন্ত বিমানের টিকিট কেটে ফেলে। পরে দালালরা কথা পাল্টে তাদেরকে ইথিওপিয়া এনে সড়কপথে মালাউই হয়ে জাম্বিয়া নিয়ে আসে। পথিমধ্যে তাদেরকে অনাহারে রাখে সেখানকার একটি চক্র।
নিহতদের এক সফরসঙ্গী জানান, জাম্বিয়ার দালাল চক্র অনেকদিন খাওয়া-দাওয়া না দিয়ে অনাহারে রাখে। পাঁচজনের জায়গায় ১৫-২০ জন লোককে এক রুমে রেখে দেয়। কেউ ঘুমায়, কেউ দাঁড়িয়ে রাত কাটায়। সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বললেই তারা মারধর করে। কোনোভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রাণে ফিরে আসি।
নিহতদের পরিবারের অভিযোগ—দালালরা এখন তাদের কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। একেক সময় এক কথা বলছে। তাদের পিতামাতা এখন সন্তান হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছেন। সন্তানদের জীবিত অথবা মৃত যে কোনো অবস্থায় ফিরে পেতে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ দূতাবাসের সহযোগিতা চেয়েছেন।
জাম্বিয়াতে বাংলাদেশি তরুণ সাইফ উদ্দিন মো. রায়হানের (২১) মৃত্যুর সাত দিন পর সোমবার রাত ১টায় তার পিতার কাছে খবর পৌঁছায়।
নিহত রায়হান চট্টগ্রাম জেলার বাঙ্গালনূরের জোরারগঞ্জের ৫ নম্বর ওয়ার্ড পশ্চিম দুর্গাপুরের দরবেশ আলী সারেং বাড়ির বাসিন্দা। এসএসসি ২০২৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার দুই ভাই—সিয়াম উদ্দিন রিহান ও আল আমিন আবির।
তার পিতা সালাউদ্দিন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের থেম্বিসায় বসবাস করেন।
নিহত রায়হানের ঘনিষ্ঠজন জানান, সরাসরি ফ্লাইটে রায়হানকে দক্ষিণ আফ্রিকা নেওয়ার কথা ছিল। পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশি ৯ লাখ টাকায় চুক্তি হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসী স্প্রিং-এর দালাল জয়নাল আবেদীন ফারুকের সঙ্গে। দক্ষিণ আফ্রিকা আসার পূর্বে ফারুককে পাঁচ লাখ টাকা দেয় তার পরিবার।
২৭ সেপ্টেম্বর রায়হানসহ ছয় তরুণ ঢাকার চাঁখারপুলে মুনিম শাহরিয়ারের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও এয়ার টিকিট বুঝে নেন। কথা ছিল দুবাই বা কাতার হয়ে আফ্রিকায় পৌঁছানোর। কিন্তু গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে সরাসরি ফ্লাইটে তাদেরকে দক্ষিণ আফ্রিকা নেওয়ার কথা থাকলেও বিমানবন্দরে পৌঁছে রায়হানসহ বাকি ছয়জন জানতে পারেন, তাদেরকে সড়কপথে নেওয়া হবে। ঢাকা থেকে ইথিওপিয়া হয়ে সড়কপথে মালাউই, সেখান থেকে জাম্বিয়া, তারপর মোজাম্বিক হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশের কথা ছিল রায়হানসহ ছয়জনের।
ছয়জনকে নিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ গাইডের নির্দেশনায় হাঁটা শুরু হয়। দুর্গম পাহাড়ি পথে পায়ে হাঁটার কারণে রায়হান ক্লান্ত হয়ে পড়েন। কঙ্গোর সীমান্ত থেকে জাম্বিয়ার পাহাড়ি পথে পায়ে হাঁটার সময় তিনি পাহাড় থেকে পড়ে যান।
রায়হানের সফরসঙ্গীদের ভাষ্যমতে, পথ দেখানো স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গরা রায়হানকে কাঁধে নিয়ে যাওয়ার সময় তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে জোরে ফেলে দেয়। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে রায়হান বলেন, ‘আমার পাসপোর্ট আর জুতাজোড়া আব্বুর কাছে পৌঁছে দিয়েন।’
রায়হানের সঙ্গীরা পরিবারকে জানান, মৃত্যুর পর দালাল চক্র তার লাশ ওই পাহাড়েই পুঁতে ফেলেছে। এতে পরিবার লাশ উদ্ধারে চরম সংকটে পড়েছে।
রায়হানের পিতা সন্তানের শোকে কান্নায় বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায় সহযোগিতা করতে ছেলেকে এখানে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছিলাম। দালালের কারণে আমার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। এমন মৃত্যু কোনো পিতা মেনে নেবে না।’
দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার যেন এই চক্রের প্রতি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে।’
এছাড়া কুমিল্লার চান্দিনার আরিফ হোসেন নামে আরও এক বাংলাদেশি জোহানেসবার্গের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বারবার সতর্ক করার পরও এক শ্রেণির আদম ব্যবসায়ী প্রতারণা করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে তরুণ একদল বাংলাদেশিকে।