তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কি আবারও ফিরছে?

জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:০৩ এএম

জাতীয় নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য দায়িত্বপালনকারী সরকারই হলো ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হওয়ার মাধ্যমেই বাংলাদেশ পেয়েছিল নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণের সুযোগ। তবে আওয়ামী লীগের শাসনামলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক রায়ে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পাল্টে যায়। এদিকে বিগত সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যেতে মামলাটি পুনরায় আপিল বিভাগের শুনানিতে ওঠে। শুনানিতে আবেদনকারীদের আরজি গৃহীত হলেই পুরাতন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ফিরে যাবে বলে প্রত্যাশা করছেন অংশীজনরা।
মামলার ইতিহাস থেকে দেখলে, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয় সংবিধানে। তবে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ তিন জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। প্রাথমিক শুনানির পর রুল জারি করেন হাইকোর্ট। তবে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট চূড়ান্ত শুনানি শেষে রিটটি খারিজ করে হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করেন।
পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করা হয়। আদালত এ মামলায় আট জন অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ করে তাদের মতামত শোনেন। তাদের মধ্যে পাঁচ জন সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে মত দেন।
তারা হলেন– ড. কামাল হোসেন, টিএইচ খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। অ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কেসি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মত দেন। এছাড়া ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ও ড. এম জহির তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের পক্ষে মত দিয়ে তাদের প্রস্তাব আদালতে তুলে ধরেন। এছাড়া তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দেন।
এরপর আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং ৩ জুলাই গেজেট প্রকাশিত হয়।
এরপর ২০১৪,২০১৮ ও ২০২৪ এই তিনটি জাতীয় নির্বাচন আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
সরকার পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট প্রথম আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি। বাকিরা হলেন– তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভুঁইয়া ও জাহরা রহমান।
পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একই বছরের ১৬ অক্টোবর এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার গত বছরের ২৩ অক্টোবর পৃথকভাবে পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। এছাড়া নওগাঁর রানীনগরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনও একই ধরনের আবেদন জানান। ফলে রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিগতভাবে মোট চারটি রিভিউ আবেদন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানিতে ওঠে।
চলতি বছরের ২৭ আগস্ট আপিল বিভাগের শুনানিতে ওঠে রিভিউ আবেদনগুলো। শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে দিয়ে সাময়িক সমাধান দিতে চায় না আপিল বিভাগ। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কার্যকর সমাধান চায় আপিল বিভাগ। যাতে এটি বারবার বিঘ্নিত না হয়। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে এটি যাতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখে, সেটিই করা হবে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে দিলে তা কখন থেকে কার্যকর হবে সে প্রশ্নও রাখেন প্রধান বিচারপতি।
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘গেলো দেড় দশকে দেশের মানুষ শাসিতের পরিবর্তে শোষিত হয়েছে নানাভাবে। মানুষ গুম-খুন বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এগুলো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যেসব সিস্টেম ছিল সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে এবং মানুষ বিচার পায়নি। যার কারণে এই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। আর সেই রাজপথ থেকেই নির্ধারিত হয়েছে কে প্রধান বিচারপতি হবেন, আর কে সরকারপ্রধান হবেন। জনগণের এই ক্ষমতাকে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। এসব অবজ্ঞা করলেই বিপ্লবের সৃষ্টি হয়।’ এ সময় তিনি ৯০’ এর গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেন।
পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি দেন আপিল বিভাগ। পাশাপাশি পুনরায় এ বিষয়ে আপিল শুনানির জন্য আগামী ২১ অক্টোবর দিন নির্ধারণ করা হয়।
মামলাটি শুনানির মধ্য দিয়ে দেশ আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাবে বলে আশা ব্যক্ত করছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।
এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আশা করি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে আমাদের আবেদন আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হবে এবং সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল হবে। অর্থাৎ সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী ফিরে আসবে। আপিল বিভাগ চাইলে তার রায়ে কিছু পর্যবেক্ষণও দিতে পারেন। এসবই আমাদের প্রত্যাশা। বাকি সব কিছু আপিল বিভাগের ওপর নির্ভর করছে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় পুনরায় ফিরে যাবে বাংলাদেশ- এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের অন্যতম আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করি আগামী ২১ অক্টোবর মামলাটির শুনানি হবে। শুনানি শেষে আমাদের আবেদন গৃহীত হবে। আমাদের আবেদন গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে যে রায় দেওয়া হয়েছিল তা বাতিল হবে বলে মনে করছি।’
এর বাইরে রায় কার্যকরের বিষয়ে কোনও পর্যবেক্ষণ বা নির্দেশনা থাকলে তা আপিল বিভাগ জানিয়ে দেবেন বলেও প্রত্যাশা করেন জামায়াতের এই আইনজীবী।