সামাজিক মাধ্যমে টাইফয়েড টিকা নিয়ে বিভ্রান্তি, জানুন আসল সত্যিটা

জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:১৬ পিএম

দেশে প্রথমবারের মতো 'টাইফয়েড' টিকাদান কর্মসূচি চলছে। কর্মসূচিটি সফলের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের প্রচারে বলা হয়েছে— 'টিকাটি নিরাপদ ও কার্যকর। এই ভ্যাকসিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যাচাই করা এবং সৌদি হালাল সেন্টার কর্তৃক হালাল সনদপ্রাপ্ত'। এ কর্মসূচির আওতায় গত দুদিনে ৩২ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি শিশু, কিশোর-কিশোরী এ টিকা নিয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
অন্যদিকে এ টাইফয়েট টিকা নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রচার চালাচ্ছে একশ্রেণির মানুষ। এটি ঠিক নয়। অনেকের মধ্যে শিশুকে টিকা দেওয়া নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিও পাওয়া যাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে টিকাবিরোধী কিংবা টিকা না নিতে উদ্বুদ্ধ করে এক ধরনের প্রচারও দৃষ্টিতে এসেছে। শিশুর জন্য এখনই এ টিকা নেওয়া ঠিক হবে কিনা' কিংবা 'পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেমন হবে'— এ ধরনের নানা উদ্বেগের কারণে অনেক অভিভাবক তার শিশুর নাম টিকার জন্য নিবন্ধন করানো থেকে বিরত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিডের জন্য বুস্টার ডোজ পর্যন্ত নিয়েও অনেকে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। সে কারণেই টিকা নিয়ে 'এক ধরনের অনাস্থা' কারও কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছে। তবে টাইফয়েডের টিকা নিয়ে 'উদ্বেগ কিংবা অনাস্থার' কোনো কারণ নেই বলেও জানিয়েছেন তারা।
চিকিৎসক ও টিকাদান কর্মসূচির সঙ্গে জড়িতরাও বলছেন, টিকা নিয়ে 'বিভ্রান্তিকর প্রচার কিংবা একটি অংশের মানুষের উদ্বেগ' তাদের দৃষ্টিতেও এসেছে। তবে তারা বলছেন, টাইফয়েডের জন্য এবার যে টিকা দেওয়া হচ্ছে, সেটি বৈজ্ঞানিকভাবে নিরাপদ ও কার্যকর।
এ বিষয়ে ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, এই টিকা ৯ মাস বয়সি শিশু থেকে শুরু করে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত সবাইকে দেওয়া যাবে। সবার জন্য নিরাপদও। টিকা দেওয়ার পর সামান্য জ্বর বা ইনজেকশনের স্থানে হালকা ব্যথা ছাড়া অন্য কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
এদিকে একটি গণমাধ্যমকে ইপিআই (সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি) প্রোগ্রামের ম্যানেজার ডা. আবুল ফজল মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেছেন, আসলে হয়তো শুরুর দিকে কেউ কেউ দেখছেন যে, দেখি অন্যরা দিয়ে নিক, তাদের কেমন হয়— এসব। তিনি বলেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই এটি ঠিক হয়ে আসবে এবং নির্ধারিত বয়সের সব শিশুকেই টিকা দেওয়া সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, দেশে ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সি শিশু, কিশোর-কিশোরীদের বিনামূল্যে এ টিকা দেওয়ার কর্মসূচি নিয়েছে সরকার এবং ১৮ দিনের এই টিকাদান ক্যাম্পেইনের লক্ষ্য হচ্ছে— ৪ কোটি ৯০ লাখ শিশুকে টাইফয়েডের টিকা দেওয়া।
গবেষণা কী বলছে: এর আগে পাকিস্তান ও নেপালেও শিশুদের এই টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নেপালে এই টিকার কার্যকরিতা নিয়ে ২০ হাজার শিশুর মধ্যে একটি গবেষণা চালানো হয়েছে। বিশ্বখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেছে। সেখানে বিস্ময়কর তথ্য উঠে এসেছে।
ল্যানসেটের গবেষণায় বলা হয়েছে— দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে টাইফয়েডের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি পাকিস্তানে সেফালোস্পোরিন অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েড ছড়িয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে টাইফয়েড থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হতে পারে ভ্যাকসিন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেপালের পাটান অ্যাকাডেমি অব হেলথ সায়েন্সেসের গবেষকরা যৌথভাবে নেপালের ললিতপুর মেট্রোপলিটন শহরে এ গবেষণা চালান। এতে ৯ মাস থেকে ১৬ বছর বয়সি সুস্থ প্রায় ২০ হাজার ১৪ জন শিশুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিশুদের দৈবচয়নের ভিত্তিতে দুটি দলে ভাগ করা হয়। একটি দলকে ভারত বায়োটেক ইন্টারন্যাশনালের তৈরি টাইফয়েড কনজুগেট টিকা (টিসিভি) দেওয়া হয়। অন্য দলটিকে দেওয়া হয় মেনিনজাইটিস 'এ' রোগের টিকা।
টিকা দেওয়ার পর প্রায় এক বছর ধরে সব শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর নিবিড়ভাবে নজর রাখা হয়। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া টাইফয়েড রোগীদের তথ্য সংগ্রহ করে দুদলের মধ্যে তুলনা করা হয়। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, যারা টাইফয়েড কনজুগেট টিকা (টিসিভি) পেয়েছিল, তাদের মধ্যে টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার হার নাটকীয়ভাবে কম, মাত্র ৭ জনের টাইফয়েড শনাক্ত হয়। বিপরীতে মেনিনজাইটিস টিকা পাওয়া কন্ট্রোল গ্রুপের মধ্যে ৩৪ জন টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়। এ তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন যে, এই টিকার কার্যকারিতা ৭৯ শতাংশ। অর্থাৎ টিকাটি টাইফয়েড হওয়ার ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে আনে।
গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, টিকাটি প্রথম বছরে ৮১ শতাংশ এবং দ্বিতীয় বছরে ৭৯ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। 'টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি)' নামের এই টিকা ৯ মাস বয়সি শিশু থেকে শুরু করে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত সবার জন্য নিরাপদ। টিকা দেওয়ার পর সামান্য জ্বর বা ইনজেকশনের স্থানে ব্যথা ছাড়া বড় কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা যায়নি।