
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গণহত্যার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হাসানুল হক ইনু ও শেখ ফজলে নূর তাপসের কথোপকথনসহ বিভিন্ন অডিও, ভিডিও ও সাক্ষীর জবানবন্দি এ মামলার অকাট্য প্রমাণ। প্রত্যক্ষদর্শী, ভিকটিম, যারা একদম ময়দানে থেকে সম্মুখসারিতে লড়াই করেছেন তাদের সাক্ষ্য এতটাই অকাট্য যে, এখান থেকে আসামিদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার তৃতীয় দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে এ কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ যুক্তিতর্ক বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেল এ দিন ধার্য করেন।
এদিন জুলাই আন্দোলনের বিভিন্ন তথ্যচিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি শেখ হাসিনার সঙ্গে হাসানুল হক ইনু, শেখ ফজলে নূর তাপসের কথোপকথনসহ কয়েকটি ফোনালাপ সবাইকে শোনানো হয়। একই সঙ্গে এ মামলায় সাক্ষ্য দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষীর বর্ণনা উপস্থাপন করা হয়।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম শুনানিতে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের ফোনালাপ অকাট্য প্রমাণ। ফোনালাপের এই রেকর্ডিং আন্দোলন দমন নিয়ে হাসিনার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার প্রমাণ। যেখানে তাকে আন্দোলকারীদের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে শোনা গেছে।
বিভিন্ন নথি থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলের ইতিহাস তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর। একই সঙ্গে গুম-খুনসহ নারকীয় সব ঘটনার বর্ণনা দেন। আর এসব বিবরণ এ মামলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান তাজুল ইসলাম। তিনি জানান, গত বছরের জুলাই আন্দোলন চলাকালীন ৪১টি জেলার ৪৩৮টি স্থানে হত্যাকাণ্ড ও ৫০টিরও বেশি জেলায় মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার শুরুতেই এ মামলায় সাক্ষ্য দেওয়া বেশ কয়েকজনের জবানবন্দি পড়ে শোনান তাজুল ইসলাম। সাক্ষীদের জবানবন্দিতে গত বছরের জুলাই আন্দোলনে দেশজুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোর বীভৎস বর্ণনা উঠে আসে। আর এসব অপরাধের জন্য দায়ী করে শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রী কামালসহ জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন শহীদ পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীরা।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন।
আমার অন্ধত্বের জন্য একমাত্র দোষী শেখ হাসিনা : চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম গত বছরের ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে এক চোখ হারানো পারভিন আক্তারের জবানবন্দি পড়ে শোনান। তাজুল ইসলাম জানান, আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা পারভিন তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘তার বয়স ২৭ বছর। তিনি ঢাকার যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী এলাকায় থাকতেন। এখন বরিশালে স্বামীর বাড়িতে থাকেন। ঢাকায় থাকা অবস্থায় তিনি দিনমজুরের কাজ করতেন। ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই প্রতিদিনের মতো জুরাইনে ৫টা পর্যন্ত কাজ করে লেগুনা স্ট্যান্ডে আসেন। তবে এখানে কোনো গাড়ি না পেয়ে হেঁটে রওনা হন। যাত্রাবাড়ী এসে দেখেন, অনেক মানুষ আহত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে ১৮-১৯ বছরের একটি ছেলেকে পড়ে থাকতে দেখেন। ছেলেটি চিৎকার করছিল আর তার সারা শরীর রক্তাক্ত ছিল। এছাড়া তার দুই চোখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। ছেলেটির গলায় একটি আইডি কার্ড ছিল। ছেলেটি শুধু বলে, আমাকে বাঁচান। এক পর্যায় ছেলেটি দাঁড়িয়ে পারভিনকে ধরে তার ঘাড়ে মাথা দেয়। পারভিন রিকশা খুঁজতে থাকেন। ছেলেটিকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। এ সময় ১৪-১৫ জন পুলিশ মারমুখী হয়ে ওই ছেলেটাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। অনেক গুলি এই ছেলেটার পিঠে লাগে। তিনি বাম হাত তুলে গুলি না করতে অনুরোধ করলে একজন পুলিশ তার বাম চোখে গুলি করে। এরপর তিনজন পুলিশ আমার তলপেটসহ কয়েক জায়গায় গুলি করে। এ সময় তার চোখ গড়িয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। রক্তে রাস্তা ভেসে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে ছেলেটিকে নিয়ে তিনি রাস্তায় পড়ে যান। মনে হচ্ছিল ওই সময় ছেলেটি মারা যায়। পরে লোকজন এসে বলে ছেলেটি তো মারা গেছে, মেয়েটি জীবিত আছে। এমন সময় একটি সিএনজি করে পারভিনকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালে আনার পর গড়িমসি করে এবং বলা হয় এটা তো পুলিশ কেস। তখন লোকজন বলে তাহলে কি উনি মারা যাবে? এ সময় একজন নার্স এসে বলে, আপনার ড্রপ লাগবে ২৫০ টাকা আছে? পারভিন বলেন, তার কাছে কোনো টাকা নেই। তখন অন্য একজন মহিলা ২৫০ টাকা দিয়ে একটি ড্রপ কিনে দেন। পরে আর কোনো চিকিৎসা না করে ডাক্তাররা চলে যান।
পারভিন জবানবন্দিতে আরও বলেন, ‘আমার এই অবস্থার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিয়ে পরদিন সকালে আমার স্বামী বরিশাল থেকে এসে পৌঁছান। তখন ডাক্তাররা তাকে বলেন আপনার স্ত্রীর অপারেশনের জন্য কিছু জিনিস কেনা লাগবে। তখন আমার স্বামী কিছু আসবাবপত্র ও আমার কানের দুল বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেন। পরবর্তীতে আমার অপারেশন হয় ও আমার চোখ থেকে তিনটি গুলি বের করা হয়। এছাড়া ডাক্তাররা দেখেন আরো গুলি ভিতরে রয়েছে। পরে আমাকে চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে যেতে বলা হয়। তখন আমার স্বামী আমাকে চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ভর্তি হওয়ার পর আমার অপারেশন হয়নি। ৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার অপারেশন হয়। এখনো আমার তলপেটে অনেক গুলি আছে, বের করা সম্ভব হয়নি। আমি এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
সাক্ষী আরও বলেন, আমি ন্যায়বিচার পেতে আপনাদের কাছে এসেছি। আমার একটি চোখ (বাম) ড্যামেজ হয়ে গেছে চিকিৎসার অবহেলার কারণে। এছাড়া আমার ডান চোখেও কম দেখি। আমার দুই সন্তানের কাছে আমি এখন অন্ধ মা হয়ে গেছি। অন্ধ হওয়ার জন্য একমাত্র দায়ী শেখ হাসিনা। আমার দুই সন্তানও চায় তার মায়ের অন্ধত্বের বিচার হোক। তাই আমি আমার অন্ধত্ব ও শহীদের এবং আহতদের জন্য বিচার চাই। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনা পুলিশের মা-বাবা। তার নির্দেশে পুলিশ গুলি করেছে। তার নির্দেশ ব্যতীত পুলিশ এভাবে গুলি করতে পারে না।’ ট্রাইব্যুনালে পারভিন সাক্ষী দেওয়ার সময় বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এদিকে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে করা মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির তারিখ ২৩ অক্টোবর ধার্য করা হয়েছে। অপরদিকে, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফসহ চার আসামিকে হাজির হতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।