Logo
Logo
×

জাতীয়

পাকিস্তানের হাত ছেড়ে আফগানিস্তান কেন ভারতমুখী হলো?

Icon

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০২:০৬ পিএম

পাকিস্তানের হাত ছেড়ে আফগানিস্তান কেন ভারতমুখী হলো?
আফগানিস্তানের ভারতঘেঁষা কূটনীতি এখন পাকিস্তানের জন্য নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালে তালেবান আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই দেশটির ওপর পাকিস্তানের দৃশ্যমান প্রভাব ছিল। তালেবানের উত্থানকে সেসময় ইসলামাবাদের ‘কৌশলগত জয়’ হিসেবেই দেখেছিলেন অনেকে। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সেই সম্পর্কের ভেতর গভীর ফাটল দেখা দিয়েছে।

সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘাত, কূটনৈতিক টানাপড়েন ও বাণিজ্যিক উত্তেজনা—সবকিছু মিলিয়ে আজ তালেবান সরকার পাকিস্তান থেকে ক্রমে দূরে সরে গিয়ে ভারতের দিকে ঝুঁকছে। এই ভূ-রাজনৈতিক মোড় শুধু ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তানেরই নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত ভারসাম্যেও বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

পাকিস্তানের ‘প্রক্সি’ থেকে ভারতের ‘অংশীদার’
আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক সবসময়ই অসমান ছিল। ১৯৭৯ সালের সোভিয়েত আক্রমণের সময় আফগান মুজাহিদীনদের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছিল পাকিস্তান, যা ১৯৯০-এর দশকে তালেবানের উত্থানের ভিত্তি তৈরি করে। পাকিস্তান আফগানিস্তানকে তার ‘কৌশলগত গভীরতা’ (স্ট্র্যাটেজিক ডেপ্থ) হিসেবে দেখতো, যাতে ভারতের প্রভাব রোধ করা যায়। ২০০১ সালে আমেরিকানদের আগমনের পরও পাকিস্তান তালেবানকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে প্রভাব বজায় রেখেছিল। ফলে, আফগানিস্তান বিভিন্ন দিক থেকে পাকিস্তান-নির্ভরতার জালে জড়িয়ে পড়ে।

বিপরীতে, ভারতের আফগানিস্তান-নীতি ছিল অনেকটাই উন্নয়নমুখী। ২০০১-২০২১ সালের মধ্যে ভারত আফগানিস্তানে ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে সালমা বাঁধ, পারওয়ান হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, সড়ক নির্মাণ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নানা প্রকল্প। তালেবান ২০২১ সালের ক্ষমতা দখলের পর ভারত প্রথমে সতর্কতা অবলম্বন করে, কিন্তু ২০২২ থেকে ‘প্র্যাকটিক্যাল এনগেজমেন্ট’ শুরু করে। এ সপ্তাহে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাওলানা আমির খান মুত্তাকিরের ভারত সফরকালে বিপুল অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং আফগান শরণার্থীদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে নয়াদিল্লি।

সীমান্তে সংঘাতে আস্থাভঙ্গ
২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সেনাদের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ ক্রমেই বেড়েছে। ডুরান্ড লাইন নিয়ে দুই দেশের বিরোধ নতুন নয়, তবে এবার তা রক্তক্ষয়ী রূপ নিয়েছে। পাকিস্তান দাবি করছে, আফগান সীমান্ত থেকে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)–এর সদস্যরা হামলা চালাচ্ছে। তবে তালেবান সরকারের দাবি, তারা টিটিপিকে আশ্রয় দিচ্ছে না; বরং পাকিস্তানই আফগানিস্তানের ভেতরে ঢুকে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে।

এই পারস্পরিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত সেপ্টেম্বর থেকে কয়েক দফা সশস্ত্র সংঘাত হয়, যাতে দুই পক্ষেরই সেনা নিহত হয়। তবে চলতি সপ্তাহে কাবুলে পাকিস্তানের কথিত বিমান হামলার পর বিরোধ চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অভিযোগ করেছে, পাকিস্তান তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে হামলা চালিয়েছে। তবে এ ঘটনার দায় স্বীকার করেনি পাকিস্তান।

এরপর, গত ১১ অক্টোবর রাতে তীব্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনী। আফগান যোদ্ধাদের হামলার পর পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু করলে সীমান্তজুড়ে ঘণ্টাব্যাপী গোলাগুলি চলে। এতে পাকিস্তানের ৫৮ সেনা নিহত হওয়ার দাবি করেছে আফগানিস্তান। আর পাকিস্তানের সামরিক বিজ্ঞপ্তি (আইএসপিআর) বলছে, তারা ২০০-এর বেশি ‘ভারত-সমর্থিত টিটিপি’ যোদ্ধাকে হত্যা করেছে।

এই ঘটনাগুলো আফগান তালেবান নেতৃত্বের মনে পাকিস্তান সম্পর্কে গভীর ক্ষোভ তৈরি করেছে। আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রতিপক্ষ (পাকিস্তান) যদি আবারও আফগানিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘন করে, তাহলে এর কঠোর জবাব দেওয়া হবে। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী দেশের সীমান্ত রক্ষার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

টিটিপি ইস্যুতে সম্পর্কের অবনতি
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিতর্কিত বিষয় হলো টিটিপি। এই সংগঠন তালেবান মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয় পাকিস্তানের ভেতরে। ইসলামাবাদ বহুবার কাবুলকে অভিযোগ করেছে, টিটিপি সদস্যরা আফগান সীমান্তে নিরাপদ আশ্রয় পাচ্ছে। অন্যদিকে তালেবান বলছে, টিটিপির সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও দমননীতির ফল।

এই টানাপড়েনে পাকিস্তানের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে আফগান সরকার। এখন তালেবান নেতৃত্ব পাকিস্তানকে এমন এক দেশ হিসেবে দেখছে, যারা তাদের স্বাধীন নীতি প্রণয়নে বাধা দিচ্ছে।

ভারতের সঙ্গে উষ্ণতা বাড়ছে
পাকিস্তানের সঙ্গে এমন টানাপড়েনের প্রেক্ষাপটেই তালেবান সরকারের দৃষ্টি এখন ভারতের দিকে। ভারত শুরু থেকেই আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে—বিশেষ করে গম, ওষুধ ও শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহের মাধ্যমে। যদিও ২০২১ সালে কাবুল পতনের পর ভারত তার দূতাবাস বন্ধ করে দেয়, তবে পরে ‘টেকনিক্যাল টিম’ পাঠিয়ে সীমিত কার্যক্রম ফের শুরু করে। এখন তালেবান সরকার সেই সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে চায়।

সম্প্রতি কাবুলে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক হয়। সেখানে শিক্ষা, অবকাঠামো, এবং বাণিজ্য বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা হয়। তালেবান মুখপাত্রদের বক্তব্য অনুযায়ী, তারা ভারতকে একটি ‘বিশ্বস্ত আঞ্চলিক অংশীদার’ হিসেবে দেখতে চায়। ভারতও সতর্কভাবে সেই সুযোগ নিচ্ছে, যদিও তারা এখনো তালেবান সরকারকে সরাসরি কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়নি।

অর্থনীতি-বাণিজ্যে নতুন মোড়
আফগানিস্তান এখন পাকিস্তানভিত্তিক ট্রানজিট রুটের ওপর নির্ভরতা কমাতে চায়। কাবুল মনে করে, ইসলামাবাদের কড়াকড়ি নীতি ও শুল্ক জটিলতার কারণে আফগান পণ্য রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর বিকল্প হিসেবে তালেবান সরকার চাবাহার বন্দরকে কাজে লাগাতে আগ্রহী, যা ভারত ও ইরান যৌথভাবে পরিচালনা করে। এই বন্দর দিয়ে ভারত-আফগানিস্তান বাণিজ্য যেমন সহজতর হবে, তেমনি পাকিস্তানকে এড়িয়ে সরাসরি সমুদ্রপথে যোগাযোগ স্থাপনও সম্ভব হবে।

এ ছাড়া ভারত পূর্বে আফগানিস্তানে কয়েক বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত ছিল—যেমন পার্লামেন্ট ভবন, সড়ক, হাসপাতাল ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। তালেবান সরকার এখন সেই সহযোগিতা ফের শুরু করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আফগান অর্থনীতির বর্তমান দুরবস্থা বিবেচনায় ভারতের বিনিয়োগ বা সহায়তা তাদের জন্য বড় স্বস্তি হতে পারে।

কৌশলগত ভারসাম্যের পুনর্বিন্যাস
পাকিস্তানের দৃষ্টিতে এই পরিবর্তন অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানকে নিজের ‘কৌশলগত গভীরতা’ হিসেবে দেখেছে—বিশেষ করে ভারতবিরোধী নিরাপত্তা ভাবনায়। কিন্তু এখন যদি কাবুল-নয়াদিল্লি সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়, তবে পাকিস্তান দ্বিমুখী চাপে পড়বে। একদিকে সীমান্ত নিরাপত্তা সংকট, অন্যদিকে কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে চলমান উত্তেজনা—দুই মিলিয়ে দেশটির সামরিক ও কূটনৈতিক ভারসাম্য নড়ে যেতে পারে।

অন্যদিকে, ভারতের জন্য এটি এক কৌশলগত সুযোগ। পাকিস্তানের তুলনায় আফগানিস্তানের জনগণের মধ্যে ভারতের ভাবমূর্তি ইতিবাচক। ভারত চাইছে, চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে মোকাবিলা করতে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন অংশীদার তৈরি করতে। তালেবান শাসনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন সেই বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনারই অংশ হতে পারে।

ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
তবে বাস্তবতা হলো—তালেবান সরকার এখনো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। নারীর অধিকার, শিক্ষা, ও মানবাধিকারের প্রশ্নে বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিরূপ মনোভাব ভারতের জন্য বড় বাধা হতে পারে। ফলে নয়াদিল্লি আপাতত নরম কূটনীতির পথেই হাঁটছে—মানবিক সহায়তা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সাংস্কৃতিক সংযোগের মাধ্যমে তারা প্রভাব বাড়াচ্ছে।

অন্যদিকে পাকিস্তানও হারানো প্রভাব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাবে নিশ্চিত। চীনের সহযোগিতায় ইসলামাবাদ হয়তো কাবুলে নতুন বিনিয়োগ প্রকল্প বা সীমান্ত নিরাপত্তা চুক্তির প্রস্তাব দিতে পারে।

সূত্র: উইকিপিডিয়া, আল-জাজিরা, ইকোনমিক টাইমস, দ্য জিওপলিটিকস

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার