আরব আমিরাতে ভিসা ‘নিষেধাজ্ঞা’: বড় ধাক্কা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে

জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:১১ পিএম

"এভারেস্টে ওঠা বরং সহজ, কিন্তু এখন ইউএই'র ভিসা পাওয়া কঠিন।" ৯-১৫ অক্টোবর আবুধাবিতে চলমান বিশ্বের শীর্ষ প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা– ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) -এর সম্মেলনে যোগ দেওয়া ২৭ সদস্যের বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলের একজন এভাবেই তুলে ধরেন তাদের ভিসা পাওয়ার ভোগান্তি।
প্রায় দুই মাস ধরে তারা ভিসা পেতে হিমশিম খেয়েছেন। এমনকী এদের মধ্যে সরকারের দুজন সচিবও আছেন। নানারকম কাগজপত্র জমা দেওয়া, কর্মকর্তাদের ফোনে অনুরোধ, আর প্রতিদিনের উৎকণ্ঠা—সবই গেছে পেরিয়ে। ৮ অক্টোবরের নিশ্চিত ফ্লাইট, সপ্তাহখানেক আগেই বুকিং করা হোটেল—সব প্রস্তুতি সত্ত্বেও ৭ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তাদের পাসপোর্টে ছিল না ভিসার ছাপ।
অবশেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুরোধের পর গভীর রাতে এসে পৌঁছায় ভিসা—তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি থাকা অবস্থায় কোনোমতে ফ্লাইট ধরতে পেরেছিলেন তারা।
ভিসা সংকটের বিস্তৃত প্রভাব
তাদের দুর্ভোগ কিন্তু একক ঘটনা নয়। বাংলাদেশের কয়েকজন অংশগ্রহণকারী ৬–৭ অক্টোবরের দুবাই ফরেক্স এক্সপোতেও ভিসা বিলম্বের কারণে অংশ নিতে পারেননি। এমনকি জাতীয় দলের ক্রিকেটার সৌম্য সরকারকেও চলতি মাসের শুরুতে ইউএই ভিসা না পাওয়ায় একটি টি–টোয়েন্টি সিরিজ মিস করতে হয়।
গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এমন ঘটনা বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। একসময় বাংলাদেশি শ্রমিক, ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গন্তব্যগুলোর একটি ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত; কিন্তু ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে ভিসা ইস্যু কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।
এক বছরের বিধিনিষেধ
এই বাধা শুরু হয় ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর, যখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর ইউএই নীরবে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়ায় অঘোষিত বিধিনিষেধ আরোপ করে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়। এরপর থেকেই হাজারো অভিবাসী শ্রমিক, পেশাজীবী ও পর্যটক পড়ে যান ভিসা প্রক্রিয়ার আমলাতান্ত্রিক অনিশ্চয়তার জালে।
উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কিছু পেশাজীবী ভিসা পেলেও—স্বল্প ও আধা–দক্ষ কর্মীদের ভিসা ইস্যু কার্যত সম্পূর্ণই বন্ধ। অথচ এ শ্রেণির কর্মীরাই হচ্ছেন বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের মূল চালিকাশক্তি।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৮ হাজার জন শ্রমিক আরব আমিরাতে গেছে—২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে যেটি ছিল ৪৭,১৬৬ জন, আর ২০২৩ সালে প্রায় ৯৭,৮২২ জন।
ভিসার এই বিধিনিষেধের সংকট শুধু শ্রম রপ্তানিতেই নয়, পর্যটন খাতেও ভয়াবহ আঘাত হেনেছে।
বিদেশগামী ট্যুর অপারেটররা বলছেন, আমিরাতের পর্যটন ভিসা ইস্যু "সম্পূর্ণ বন্ধ" থাকায় তাদের ইউএই–ভিত্তিক ট্যুর ব্যবসা কার্যত "ধসে পড়েছে"।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) এর পরিচালক (বাণিজ্য ও মেলা) তসলিম আমিন শোভন বলেন, "২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতি বছর আমি দুই হাজারের বেশি আরব আমিরাতের পর্যটন ভিসা প্রসেস করেছি। গত এক বছরে একটিও করতে পারিনি। মনে হচ্ছে সীমিত সংখ্যক কিছু পেশাজীবীর জন্য ছাড়া, ভিসার অন্য সব ক্যাটাগরিই বন্ধ।"
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সাবেক মহাসচিব আব্দুস সালাম আরেফ বলেন, "এখন পর্যটন ও ট্রানজিট ভিসা প্রায় শূন্যের কোটায়। শ্রম ভিসা আগের তুলনায় মাত্র ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ইউএইগামী যাত্রীদের ওপর নির্ভরশীল এয়ারলাইনগুলোকেও যাত্রীসংখ্যা পূরণে হিমশিম খেতে হচ্ছে।"
কূটনৈতিক তৎপরতা ফলশূন্য
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, বিষয়টির সমাধানের জন্য আমিরাতের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ চলছে, তবে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এস এম মাহবুবুল আলম বলেন, "আমাদের মন্ত্রণালয় ও ঢাকায় আমিরাতের মিশন বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে। প্রতিটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকেই আমরা বিষয়টি উত্থাপন করছি। ইউএই মিশনও তাদের দিক থেকে তৎপর।"
তবে তিনি স্বীকার করেন, "শেষপর্যন্ত এটি আমিরাত সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে। তবে ঢাকাও শিগগিরই ইতিবাচক সমাধান হবে বলে আশা করছে।"
কর্মকর্তাদের অস্বীকার বনাম বাস্তব পরিস্থিতি
২২ সেপ্টেম্বর, আবুধাবিতে বাংলাদেশ দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানায়, ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে ইউএই বাংলাদেশিদের ভিসা নিষিদ্ধ করছে—এমন কোনো খবর সঠিক নয়। তারা জানায়, "ইউএই কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে যে এমন কোনো সরকারি ঘোষণা দেওয়া হয়নি," এবং খবরটি "একটি যাচাইবিহীন ভিসা ওয়েবসাইটের বিভ্রান্তিকর তথ্য।"
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র—অধিকাংশ ভিসা ক্যাটাগরির প্রসেসিং কার্যত স্থবির।
ইউএই'র ফ্ল্যাগশিপ এয়ারলাইন এমিরেটসের এক স্থানীয় এজেন্ট বলেন, "ইউরোপ বা অন্যান্য গন্তব্যে পৌঁছাতে বাংলাদেশ থেকে আমাদের প্রায় ৮০ শতাংশ যাত্রী দুবাইকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে। প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি দুবাইয়ে বসবাস করছেন, যাদের একাংশ নিয়মিত দেশে যাতায়াত করে। তাই ভিসার বিধিনিষেধে আমাদের যাত্রীসংখ্যায় কোনো প্রভাব পড়েনি।
তবে তিনি জানান, ট্রানজিট ভিসাও এখন সীমিত, যদিও "বিশেষ শর্তে শিগগিরই তা চালু হতে পারে।"
প্রধান এক শ্রমবাজার সংকটে
অনানুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় ১২ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক আছেন। ভারতীয় ও পাকিস্তানীদের পর বাংলাদেশদেশিরাই সেখানে তৃতীয় বৃহৎ প্রবাসী সম্প্রদায়।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ থেকে ইউএই গেছে মাত্র ১,৬০০ শ্রমিক, যার বেশিরভাগই দক্ষ বা আধা–দক্ষ পেশাজীবী; অথচ বিধিনিষেধের আগে এ সংখ্যা মাসেই ছিল ৫,০০০ থেকে ৬,০০০।
দুবাই ও নর্দার্ন এমিরেটসের বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মো. রাশেদুজ্জামান স্থানীয় পত্রিকা খালিজ টাইমস–কে বলেন, "ভিসার বিধিনিষেধ শিথিল করার জন্য আমিরাতের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।"
কেন এই স্থবিরতা?
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিক্ষোভের পর থেকেই এ বিধিনিষেধ শুরু হয়। যদিও কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নেই, কিন্তু নিষেধাজ্ঞার এই প্রভাব এখনো বহাল রয়েছে, বিশেষ করে স্বল্প দক্ষ কর্মী ভিসার ক্ষেত্রে।
এদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার, ফলে এই স্থবিরতা দেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে বড় ধাক্কা দিয়েছে।
সরকারের সংশ্লিষ্টরা জানান, শ্রমিক বিক্ষোভই একমাত্র কারণ নয়। নিয়োগ জালিয়াতি, ভুয়া কাগজপত্র এবং ভিসা বিধি লঙ্ঘনের ঘটনাও আমিরাতকে বাংলাদেশি আবেদনকারীদের যাচাইয়ে আরও কঠোর হতে বাধ্য করেছে।
প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী গত ১৭ জুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছিলেন, আমিরাতের অভিবাসন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি জানতে পেরেছেন, আমিরাতে সব ধরনের ভিসা বা আবাসনবিধি লঙ্ঘনকারীর মধ্যে ২৫ শতাংশের বেশি হলেন বাংলাদেশি।
তিনি আরও বলেন, মূল সমস্যা সম্ভবত আমাদের এখানে নিয়োগ প্রক্রিয়ার শুরুতেই—দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও অনানুষ্ঠানিক শ্রম নেটওয়ার্কের কারণে, শ্রমিকদের শোষণ যেমন করা হয়, তেমনি এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি-ও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।"