নয় মাসে ডিজিটাল সহিংসতার শিকার ২৯ অভিনেত্রী

জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৫, ০১:২০ এএম

বাংলাদেশে অপতথ্য ও গুজবের তীর অধিংকাংশ ক্ষেত্রে নারীদের লক্ষ্য করেই ছোঁড়া হয়। এটি একটি উদ্বেগজনক সামাজিক ও ডিজিটাল সমস্যা হিসাবেও চিহ্নিত হচ্ছে। চলতি বছরের নয় মাসে যত গুজব, অপপ্রচার ও অপতথ্য ছড়িয়েছে তার ২১ শতাংশ নারীদের ঘিরে। এই সময়ের মধ্যে ২৭৬ জন নারীকে জড়িয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে। এসব তথ্য জানিয়েছে রিউমর স্ক্যানার।
প্রতিষ্ঠানটির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এসব অপতথ্যের শিকার হয়েছেন রাজনীতি, বিনোদনসহ বিভিন্ন অঙ্গনের পরিচিত ব্যক্তিরা। এমনকি সাধারণ অনেক নারীও নিয়মিত ডিজিটাল সংহিসতার শিকার হচ্ছেন। তবে এসব নারীর মধ্যে বিনোদন জগতের নারীর সংখ্যা বেশি। শোবিজের বিভিন্ন মাধ্যমের নারীদের নিয়ে ভুয়া ভিডিও, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি কনটেন্ট, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কনটেন্ট কিংবা মৃত্যুর গুজবও ছড়ানো হয়েছে।
ডিজিটালি এসব সহিংসতার কারণে সামাজিকমাধ্যমে নারী শিল্পীরা প্রতিনিয়ত হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। এটিও নতুন কিছু নয়। প্রায়ই নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, বডি শেমিং, এমনকি অপতথ্যের শিকারও হতে হচ্ছে তাদের। এরমধ্যে যোগ হয়েছে ডিপফেক প্রতারণা। সম্প্রতি এই ডিপফেক ছবি কিংবা ভিডিওর কারণে শিল্পীরা হচ্ছেন বিব্রত, রয়েছেন নিরাপত্তাহীনতায়। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশও করেছেন। কিন্তু দিনে দিনে এর মাত্রা বেড়েই চলেছে।
রিউমর স্ক্যানারের তথ্যমতে, চলতি বছরের নয় মাসে শোবিজের ২৯ নারীকে জড়িয়ে ছড়ানো হয়েছে ৬৮টি গুজব ও অপতথ্য। এর মধ্যে ৫০টি কনটেন্টের ক্ষেত্রে এআই বা ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সামাজিকমাধ্যমে অপতথ্যের শিকার নারীদের মধ্যে শোবিজ তারকা বেশি। অপতথ্য ও ডিপফেকের শিকার হওয়া নারী শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা, সাদিয়া আয়মান, আজমেরী হক বাঁধন, প্রার্থনা ফারদিন দীঘি, তানজিম সাইয়ারা তটিনী, বিদ্যা সিনহা সাহা মিম, তাসনিয়া ফারিণ, মাহিয়া মাহি, শবনম বুবলী, অপু বিশ্বাস, নাজনীন নাহার নিহা, রাফিয়াথ রশিদ মিথিলা, মেহজাবীন চৌধুরী, শবনম ফারিয়াসহ অনেকে। তাদের নিয়ে ছড়িয়ে দেয়া ভুয়া এসব কনটেন্টের ক্ষেত্রে ৩৬টি ঘটনাতেই ব্যবহার হয়েছে ভারতীয় নারীর ফুটেজ, যেগুলোকে বাংলাদেশের বিনোদন তারকার ছবি বা ভিডিও দাবি করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ফেসবুক পেইজ থেকে। সাধারণ দর্শকও এসব সত্যি ভেবেই গিলেছেন গোগ্রাসে, করেছেন ভাইরাল। আর তাতেই সম্মানহানির পাশাপাশি বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও পড়তে হচ্ছে শিল্পীদের।
গত নয় মাসে সবচেয়ে বেশি অপতথ্যের শিকারে হয়েছেন অভিনেত্রী সাদিয়া আয়মান। তাকে জড়িয়ে প্রচার হওয়া ১১টি ভুয়া কনটেন্টের ১০টিই ছিল এআই কেন্দ্রিক।
সাদিয়া জানান, যারা এই কাজটা করছে তারা ভয়াবহ ক্রাইম করছে। তাদের বিষয়ে কোনো আইনী পদক্ষেপ নিবেন কিনা এ প্রশ্নের জবাবে অভিনেত্রী বলেন, ‘এককভাবে সমাধানের পথে না গিয়ে এই সমস্যায় যারা পড়ছেন তারা একজোট হয়ে এ বিষয়টির সমাধানের পথ বের করা উচিত।’
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে মাঠে ছিলেন সাদিয়া আয়মান। আন্দোলন পরবর্তী আলাদাভাবে গুজবের টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে অভিনেত্রী বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের পক্ষে আমি কথা বলেছি। আমি কোনো রাজনীতির জায়গা থেকে এটা করিনি। রাজনীতির নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে পছন্দ করি বা অন্যায় হলে সেটার বিরুদ্ধে কথা বলতে পছন্দ করি। এটা সত্য যে, জুলাই আন্দোলনের পরে আমি বা আরো কয়েকজন আছে যারা এটার পক্ষে কথা বলেছে তারা সমস্যার মুখে পড়েছে। এআইয়ের যে ব্যাপারটা চলছে, এটিও আমার মনে হয় কোনো একটা পক্ষ বুঝেশুনেই এটা করছে। আমি এখনও সোশাল মিডিয়ায় অনেক কমেন্ট ও মেসেজ পাই, যেগুলো থেকে বোঝা যায় জুলাই আন্দোলনে সরব ছিলাম দেখেই আমাকে এখন এরকম কথা শুনতে হচ্ছে।’
অভিনেত্রী নাজনীন নাহার নিহাও চলতি বছরে একাধিকবার অপতথ্যের শিকার হয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাকে নিয়ে বানানো একাধিক ডিপফেক ছবি। সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিকবার ভুয়া ছবি ও এডিটিং কাণ্ডের মুখোমুখি হয়েছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়াও। তবে তিনি চুপ থাকেননি, বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। এছাড়া এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীও। তিনি মনে করেন, তথ্যপ্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে শুধু তারকা নন, অনেক সাধারণ নারীর ছবি এবং ভিডিও বিকৃত করে প্রচার করছে একটি কুচক্রীমহল। এই শ্রেণির মানুষদের আইনের আওতায় আনা উচিত বলে মনে করেন এ অভিনেত্রী।
এ প্রসঙ্গে মেহজাবীন বলেন, ‘প্রযুক্তি আজ আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। আমরা অনেকেই এর ভালো দিকগুলো নিয়ে আশাবাদী, কিন্তু এর অন্ধকার দিকও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এআই এখন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রযুক্তি। কিন্তু এটা যখন ভুল মানুষের হাতে পড়ে, তখন তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিকৃত ছবি বা ভিডিও তৈরির ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, যারা সারাদিন ধরে শুধুই এসব করে বেড়ায়। তারা ভুল তথ্য ছড়ায়, বিভ্রান্তি তৈরি করে, মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে। এটা শুধু অনৈতিক নয়, এটা ফৌজদারি অপরাধও বটে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড এক ধরনের ডিজিটাল সহিংসতা।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর অপব্যবহার রোধ করতে আমাদের দরকার কঠোর আইন, শক্ত প্রতিরোধ, আর জনসচেতনতা। আশা করি, আমাদের দেশে দ্রুত এমন নিয়মকানুন ও শাস্তির ব্যবস্থা হবে, বিশেষ করে নারীদের জন্য, একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশ তৈরি করবে।’
অনুসদ্ধানে দেখা গেছে, ‘চলো বদলে যাই’ নামের একটি ফেসবুক পেইজ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় শিল্পীদের এসব ভুয়া ছবি এবং ভিডিও ভাইরাল করা হয়। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি পেইজ এ অপরাধগুলো নিয়মিতই করে আসছে, যা নিয়ে উদ্বিগ্ন শিল্পীরা।
প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের পাশাপাশি এর অপব্যবহারের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে, প্রযুক্তিগত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেকেই। অপব্যবহারের ফলে ঘটছে অনেক অঘটনও। দ্রুত এ বিষয়ে উদ্যোগ না নিলে বিরূপ প্রভাব পড়বে পুরো ইন্ডাস্ট্রিতে-এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ বিভাগও কাজ করছে বলে জানা গেছে। তারা জানিয়েছেন, কারও অনুমতি ছাড়া আপত্তিকর ছবি কিংবা ভিডিও বানিয়ে প্রকাশ করা সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এ দণ্ডনীয় অপরাধ। ভুক্তভোগীরা বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টার, ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ ও পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের অভিযোগকেন্দ্রে অভিযোগ জানাতে পারেন।