Logo
Logo
×

জাতীয়

বিশ্বে স্বর্ণের দাম কেন বাড়ছে, বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ ?

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৫০ পিএম

বিশ্বে স্বর্ণের দাম কেন বাড়ছে, বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ ?

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে মূল্যবান ধাতুগুলোর দাম ক্রমাগত বাড়ছে। বিশেষ করে স্বর্ণের দাম গত এক বছরে বেড়েছে আকাশছোঁয়া- ৫০ শতাংশের বেশি। বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের তুলনায় কম দামে যেসব দোকানি গলার হার ও কানের দুল বিক্রি করতে চান, তাদের জন্য স্বর্ণের ভবিষ্যত বাজার উদ্বেগের কারণ হয়েছে। 

আর্থিক পরিষেবা সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাকসের মতে, বাজারে স্বর্ণের দাম ওঠানামা স্বাভাবিক হলেও, গত এক বছরে মন্দার আশঙ্কা এবং বাজারের অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের মজুত বাড়িয়েছেন। 

গতকাল মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো স্বর্ণের দাম প্রতি আউন্সে ৪ হাজার ডলারে পৌঁছেছে। এই বৃদ্ধির গতি এখনই থামার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ব বাজারের এই প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম বেড়েছে ১ হাজার ৩৬৯ টাকা। গত কয়েক মাস ধরে দাম বাড়তে বাড়তে এখন ২২ ক্যারেট মানের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম পড়ছে ২ লাখ ২ হাজার ১৯৫ টাকা। যা এখন পর্যন্ত দেশের বাজারে সর্বোচ্চ দাম। 

বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাজুস জানিয়েছে, স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণের (পাকা) দাম বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বগতির কারণে আবারও স্বর্ণের দাম বাড়ল। যা আজ বুধবার থেকে কার্যকর হয়েছে। 

প্রশ্ন হলো আন্তর্জাতিক বাজরে স্বর্ণের দাম আকাশছোঁয়া কেন হচ্ছে? কিসের ভিত্তিতে দাম ওঠানামা করে? অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে স্বর্ণে বিনিয়োগ বাড়লেও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কী পূর্বাভাস দিচ্ছেন? এসব প্রশ্নের উত্তরের আগে জানা যাক স্বর্ণ কেন এতো জনপ্রিয়।

কেন জনপ্রিয়, কেনার পদ্ধতি

নতুন বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন ধরনের ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট ও প্ল্যাটফর্ম সুবিধা দেয় অস্ট্রেলিয়ার কেসিএম ট্রেড। এর প্রধান বাজার বিশ্লেষক টিম ওয়াটারের মতে, অনিশ্চয়তা বা অস্থিরতার সময় বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের দিকে ঝোকেন। এটি বহুল প্রচলিত প্রবণতা। এর কারণ হলো- অন্যান্য সম্পদের তুলনায় স্বর্ণের মূল্য তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল।

রয়টার্স ও আল জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। যারা সরকার বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থাহীন, তাদের কাছেও স্বর্ণ জনপ্রিয়। কারণ এটি এমন একটি পণ্য যেটির সরাসরি মালিক হওয়া ও মজুত করা যায়।

স্বর্ণ বাণিজ্যের দুটি প্রধান পদ্ধতি আছে। প্রথমটি হলো, বুলিয়ন সোনা কেনা। যেমন বার, ইনগট, গয়না বা কয়েন আকারে। দ্বিতীয়টি হলো, ফিউচারস মার্কেট। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট দামে স্বর্ণ কেনাবেচার চুক্তি হয়। 

এ ছাড়া, বড় ক্রেতা ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সাধারণত বড় ব্যাংক থেকে স্বর্ণ কেনেন। স্পট মার্কেটে দাম নির্ধারিত হয় তাৎক্ষণিক চাহিদা ও যোগানের গতিশীলতার ওপর ভিত্তি করে। মূলত, লন্ডন বুলিয়ন মার্কেট অ্যাসোসিয়েশনের (এলবিএমএ) কারণে লন্ডন হলো স্পট গোল্ড মার্কেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী কেন্দ্র। এলবিএমএ স্বর্ণ বাণিজ্যের মানদণ্ড নির্ধারণ করে এবং ব্যাংক, ডিলার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘ওভার-দ্য-কাউন্টার’ লেনদেনের জন্য কাঠামো ঠিক করে দেয়। এছাড়া চীন, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্র স্বর্ণ বাণিজ্যের অন্যান্য প্রধান কেন্দ্র।

লেনদেনের পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গোল্ড ফিউচার মার্কেট হলো নিউ ইয়র্ক মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জ এর কমোডিটি এক্সচেঞ্জ ইনকরপোরেশন (কমেক্স)। এ ছাড়া, চীনের সাংহাই ফিউচার এক্সচেঞ্জেও গোল্ড ফিউচারস কনট্রাক্ট কেনাবেচা হয়। এশিয়ার স্বর্ণের বাজারে আরেকটি বড় খেলোয়াড় হলো জাপানের টোকিও কমোডিটি এক্সচেঞ্জ (টোকম)।

বিশ্বে দাম কেন বাড়ছে

রয়টার্স জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে বিনিয়োগে বাড়তে থাকা আগ্রহই স্বর্ণের দাম ওঠানামার মূল কারণগুলোর একটি। এ ছাড়া, মুদ্রা বাজারে অস্থিরতার বিপরীতে ঝুঁকি কমানোর কৌশল হিসেবেও স্বর্ণকে ব্যবহার করা হয়। 

ঐতিহ্যগতভাবেই স্বর্ণ মার্কিন ডলারের বিপরীতে অবস্থান করে। ডলারের মূল্য কমলে স্বর্ণের মূল্যও কমে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। তাই ডলার দুর্বল হওয়ার সময় স্বর্ণের দাম বেড়ে যায়।

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ হয়েছে চীনের পণ্যেও। বিশ্ব বাণিজ্যে যে উত্তেজনা চলছে, সেটি মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা বাড়িয়েছে। এতে মার্কিন মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা তৈরি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নীতিও স্বর্ণের দামের গতিপথকে প্রভাবিত করে। 

রাজনীতি ও দুর্বল মুদ্রার প্রভাব

মার্কিন ডলার যেহেতু বিশ্বের অধিকাংশ দেশের আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যম তাই, মন্দার পূর্বাভাস পেলে অনেক দেশ ডলার সংরক্ষণ শুরু করে। যেটা বড় ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, গত কয়েক মাস ধরেই ডলারের মান কমছে। ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কর্তন করায় চলতি বছর ডলারের মান ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। সবশেষ সরকারি দপ্তরে শাটডাউন শুরু হওয়ায় অনেক মার্কিন নাগরিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। ফলে ডলার সংরক্ষণের বদলে অনেকে স্বর্ণে বিনিয়োগ করছেন। 

ডলারের পর আরেকটি জনপ্রিয় মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয় জাপানি ইয়েন’কে। কিন্তু এটির মানও দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সানায়ে তাকাইচি নির্বাচিত হওয়ার খবরে দুর্বল হয়েছে। কারণ, সানায়ে রাজনৈতিক দর্শন অনুযায়ী ব্যয়, করছাড় ও কম সুদের হারকে সমর্থন করেন। 

প্রায় কাছাকাছি সময়ে ইউরোপের দেশ ফ্রান্স রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সাক্ষী হয়েছে। মন্ত্রীসভা গঠনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী সেবাস্তিয়ান লকর্নু। নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, এই ঘটনাও ইউরোর মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সবকিছু মিলিয়ে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করেছেন।

বিনিয়োগের সতর্কতা

স্বর্ণের দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যে এতে বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে মার্কিন গণমাধ্যম এবিসি নিউজ। যেখানে বিশ্লেষকদের পরামর্শ তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্ববাজারের দাম যেহেতু বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলে সুতরাং এসব পরামর্শ বাংলাদেশিদের জন্যেও প্রযোজ্য হতে পারে।

এবিসি নিউজ বলছে, স্বর্ণে বিনিয়োগের পক্ষপুষ্টরা এটিকে ‘সেফ হেভেন’ বা নিরাপদ আশ্রয় বলে অ্যাখ্যা দেন। কিছু বিনিয়োগকারী দৃশ্যমান সম্পদ কিনে রাখাটা স্বস্তিদায়ক মনে করেন। ভাবেন ভবিষ্যতে দাম আরও বাড়বে। এরপরও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, সবকিছু এক জায়গায় বিনিয়োগ করা উচিত নয়। 

দ্য কমোডিটি ফিউচারস ট্রেড কমিশনও স্বর্ণে বিনিয়োগের সময় সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়। কমিশন বলছে, মূল্যবান ধাতু অনেক বেশি অস্থির। অর্থনৈতিক উদ্বেগের ফলে এর চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দামও বেড়ে যায়। চলতি বছরের শুরু থেকে অনেকে এতে বিনিয়োগ করে লাভবান হয়েছেন। আবার ক্ষতির মুখে পড়ার উদাহরণও আছে। যেমন গত ২ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বিশ্বজুড়ে পারস্পরিক শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন, তখনই স্বর্ণের দাম পড়ে যায়।

তাই কমোডিটি ফিউচারস ট্রেড কমিশন বলছে, স্বর্ণে বিনিয়োগের আগে নিরাপদ ট্রেডিং প্র্যাকটিস সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখাটা জরুরি। এ ছাড়া, বাজারে সম্ভাব্য প্রতারণা ও নকল থেকেও সতর্ক থাকতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার