শাহজালালে একাধিক ফ্লাইট অবতরণ করলে দেখা দেয় ট্রলি সংকট

জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০১:২৭ পিএম

বুধবার (১ অক্টোবর) ভোর ৪টা। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আকাশে তখন তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। নিরাপদে অবতরণ করতে না পেরে ঢাকার চারপাশে চক্কর দিচ্ছিল বিভিন্ন দেশ থেকে যাত্রী নিয়ে আসা পাঁচটি উড়োজাহাজ। এক পর্যায়ে বৃষ্টি কিছুটা কমলে উড়োজাহাজগুলো অবতরণের অনুমতি দেয় কর্তৃপক্ষ।
পরে একে একে নিরাপদে অবতরণ করে উড়োজাহাজগুলো। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেন যাত্রীরা। কিন্তু এর পরই ঘটে বিপত্তি। দৌড়ে সব যাত্রী ছুটে যান ট্রলি আনতে। পর্যাপ্ত ট্রলি এবং শৃঙ্খলা না থাকায় শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি-হাতাহাতি। তাদের নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খান নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এভাবে ঘণ্টাখানেক ধরে বিমানবন্দরে চরম বিশৃঙ্খলা চলতে দেখা যায়।
যাত্রীদের অভিযোগ, শাহজালাল বিমানবন্দরে ট্রলি সংকট এবং বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা দিন দিন বাড়ছে। আবার বিমানবন্দর থেকে ট্রলিতে লাগেজ নিয়ে বের হতেও ঘটছে বিপত্তি। কারণ, টার্মিনাল-১ ও ২ এর ‘ক্যানোপি’ গ্রিল দিয়ে আটকানো। ফলে ট্রলিতে মালামাল নিয়ে টার্মিনালের বাইরে যেতে পারছেন না যাত্রীরা। বাধ্য হয়ে মাথায় লাগেজ নিয়ে বের হচ্ছেন। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়ছেন বয়স্ক, নারী-শিশু ও অসুস্থ যাত্রীরা। অথচ বিশ্বের সব বিমানবন্দরেই ট্রলি নিয়ে বিমানবন্দর এরিয়ার যে কোনো প্রান্তে মালামাল বহন করতে পারেন যাত্রীরা।
তবে বিমানবন্দরে ট্রলি সংকট ও ট্রলি নিয়ে বের হওয়ার সুযোগ বন্ধের বিষয়ে ঠুনকো যুক্তি দিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। তাদের দাবি, বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত ট্রলি আছে। কিন্তু যখন একসঙ্গে চার-পাঁচটি উড়োজাহাজ অবতরণ করে, তখন ট্রলি সরবরাহে কিছুটা চাপ তৈরি হয়। এ চাপ লাঘবেই ক্যানোপির বাইরে ট্রলি নেওয়ার পথ বন্ধ করা হয়েছে।
ক্যানোপি থেকে ট্রলি যাতে বের হতে না পারে এজন্য দেড় ফুট উঁচু করে স্টিলের বেড়া দিয়ে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। তাই বাধ্য হয়ে লাগেজ কাঁধে নিতে হয়েছে। অথচ সারারাত ভ্রমণ করে শরীর খুবই ক্লান্ত লাগছে।-সৌদি প্রবাসী ফারুক হোসেন
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সার্বিক দেখভাল করে বেবিচক। বেবিচক সূত্র জানায়, এখন প্রতিদিন প্রায় ৩০টি যাত্রীবাহী এয়ারলাইন্সের ১৪০ থেকে ১৫০টি ফ্লাইট ওঠানামা করে। এসব ফ্লাইটে দিনে প্রায় ২২ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। কিন্তু যখন একসঙ্গে কয়েকটি উড়োজাহাজ অবতরণ করে তখন ট্রলি সংকট দেখা দেয়। এতে প্রায়ই ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। তবে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এসব সমস্যার সমাধান হবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ১ অক্টোবর ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে সৌদি আরবের দাম্মাম থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ অবতরণ করে। একইভাবে ৪টা ২৫ মিনিটে মায়লেশিয়ার কুয়ালালামপুর, ৪টা ৪৫ মিনিটে কুয়েত থেকে বিমানের আরও দুটি উড়োজাহাজ অবতরণ করে। এছাড়া ৫টায় সৌদি আরবের মদিনা ও ৫টা ১০ মিনিটে তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে আরও দুটি উড়োজাহাজ যাত্রী নিয়ে শাহজালালে অবতরণ করে। ঘণ্টাখানের মধ্যে এমন পাঁচটি উড়োজাহাজ অবতরণ করায় বিমানবন্দরের ভেতর এক ধরনের জটলা তৈরি হয়। বিশেষ করে ইমিগ্রেশনের সামনে মানুষের ভিড় বেড়ে যায়। এখান থেকে বের হয়ে প্রতিটি লাগেজ বেল্টের চারপাশে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় তৈরি হয়।
এর মধ্যে সকাল ৬টার দিকে ৫ নম্বর বেল্টের পূর্বপাশে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। এখানে লাগেজ বহনের জন্য ট্রলি পেতে শত শত মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু তাদের সামনে কোনো ট্রলি নেই। ৬টা ৯ মিনিটে ক্যানোপি থেকে ২০ থেকে ২৫টি ট্রলি সরবরাহ করেন বিমানবন্দরে দায়িত্ব থাকা আনসার সদস্যরা। তখন এ ট্রলি নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন যাত্রীরা। একেকটি ট্রলি নিয়ে তিন-চারজন টানাটানি করতে থাকেন। একে অন্যকে ধাক্কা দিচ্ছেন। কয়েকজন যাত্রীকে তর্ক ও হাতাহাতি করতেও দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন নিরাপত্তায় থাকা কর্মীরা। এভাবে সকাল ৭টা পর্যন্ত বিমানবন্দরে ট্রলি নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে দেখা যায়।
অনেক সময় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থাকলে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি ফ্লাইট অবতরণ করে। তখন যাত্রীদের মধ্যে ট্রলির চাহিদা বেড়ে যায়। আবার যদি নির্দিষ্ট সময় পরপর ফ্লাইট অবতরণ করে তাহলে এ সমস্যা থাকে না। তারপরও আমরা আরও পাঁচ শতাধিক ট্রলি সংগ্রহের চেষ্টা করছি।- শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ
কুয়ালালামপুর থেকে স্থানীয় সময় রাত আড়াইটায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি৩৮৭ ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন প্রবাসী মহসিন আলী। ইমিগ্রেশন শেষ করে প্রায় ৩০ মিনিট ট্রলির জন্য তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘সারারাত জার্নি করে এখন নিজ দেশে নেমে ট্রলির জন্য লম্বা সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পরপর কিছু ট্রলি দেওয়া হলেও তা নিয়ে টানাটানি চলছে। এতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় ১৫ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় পরিবার নিয়ে বাস করি। বছরে এক-দুবার দেশে আসি। প্রতিবারই দেখি ট্রলি নিয়ে টানাটানি চলছে। এভাবে তো একটা বিমানবন্দর চলতে পারে না। অথচ মালয়েশিয়ায় কখনোই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি।’
সৌদি আরব থেকে ওমরাহ করে সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজে দেশে ফেরেন সিরাজগঞ্জের ফজলুল হক (৬০)। ট্রলির জন্য তিনিও ৪ নম্বর লাগেজ বেল্টের পূর্বপাশে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আলাপকালে তিনি বলেন, ‘ট্রলির জন্য যেভাবে ধাক্কাধাক্কি চলছে, বৃদ্ধ বয়সে শরীরে এমন শক্তি নেই। কর্তৃপক্ষের লোকজন কেউ সহযোগিতা করছে না। দেখি এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ট্রলি পাওয়া যায়।’
৫ নম্বর লাগেজ বেল্টের পূর্বপাশে এক ট্রলি নিয়ে টানাটানি করছিলেন দুই মালয়েশিয়া প্রবাসী আলাউদ্দিন গাজী ও আলমগীর হোসেন। জানতে চাইলে আলাউদ্দিন বলেন, ‘বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীরা ট্রলি সরবরাহের পর প্রথমে আমি ট্রলিতে হাত দেই। তখন আরেক পাশ থেকে ট্রলি ধরে টান দেন আরেকজন (আলমগীর)।’ আলমগীরের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি ট্রলি ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে চলে যান।
শাহজালাল বিমানবন্দর সূত্র জানায়, এখন শাহজালালে তিন হাজার ৬শ ট্রলি রয়েছে। এর মধ্যে আগমনী ও বহির্গমনে ১৫শ করে রাখা আছে। তবে পরপর চার-পাঁচটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট অবতরণ করলেই ট্রলি সংকট হয়। কারণ, একেকটি উড়োজাহাজে ২৫০ থেকে ৪শ পর্যন্ত যাত্রী থাকে।
শাহজালাল বিমানবন্দরে এই ট্রলি ভোগান্তির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ ভোগান্তি কমাতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বেবিচক নানা উদ্যোগ নিলেও তা বিশেষ কাজে আসেনি।
ক্যানোপি-২ এর ভিতর থেকে লাগেজ কাঁধে নিয়ে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় যাচ্ছিলেন সৌদি প্রবাসী জামালপুরের ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, ‘ক্যানোপি থেকে ট্রলি যাতে বের হতে না পারে এজন্য দেড় ফুট উঁচু করে স্টিলের বেড়া দিয়ে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। তাই বাধ্য হয়ে লাগেজ কাঁধে নিতে হয়েছে। অথচ সারারাত ভ্রমণ করে শরীর খুবই ক্লান্ত লাগছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ট্রলি সরবরাহসহ হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে চার্জ দেয়। এটি বিমানের আয়ের অন্যতম বড় খাত। কিন্তু এই খাতে পর্যাপ্ত জনবল ও সরঞ্জাম নেই। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য তদারকি টিম নেই। ফলে বিমানবন্দরে যখন একসঙ্গে একাধিক ফ্লাইট আসে, তখন দায়িত্বে থাকা কর্মীদের হিমশিম খেতে হয়। এতে যাত্রী ও বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ক্ষুব্ধ হয়। কারণ, লাগেজ বিড়ম্বনায় এয়ারলাইন্সগুলোকে ইমেজ সংকটে পড়তে হচ্ছে।
জানতে চাইলে শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ বলেন, ‘অনেক সময় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থাকলে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি ফ্লাইট অবতরণ করে। তখন যাত্রীদের মধ্যে ট্রলির চাহিদা বেড়ে যায়। আবার যদি নির্দিষ্ট সময় পরপর ফ্লাইট অবতরণ করে তাহলে এ সমস্যা থাকে না। তারপরও আমরা আরও পাঁচ শতাধিক ট্রলি সংগ্রহের চেষ্টা করছি। আশাকরি শিগগির ব্যবস্থা করতে পারবো। শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এ সংকট বা সমস্যা অনেকাংশেই কমে যাবে।’