
রাজধানীতে এক চিলতে নদী তীরের সাদৃশ্য গ্রাম হলো গুলশান-বনানী ও মহাখালী এলাকার মাঝখানে গড়ে ওঠা কড়াইল বস্তি। গুলশান-বনানী লেকটি তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে এই কড়াইল বস্তিকে।
রাজধানীর দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, গার্মেন্টস শ্রমিক, দিনমজুর, গৃহকর্মী, রিকশাওয়ালাসহ কায়িক শ্রমজীবীদের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে এ বস্তিটি।সড়কপথে টিঅ্যান্ডটি কলোনি পার হয়ে বস্তির মধ্য দিয়ে বেলতলা গলি ধরে পশ্চিম দিকে ঘুরে মূল সড়কে উঠতে সময় লাগে ৪০ মিনিটের বেশি। অথচ নৌকায় মাত্র ৫ মিনিটেই পৌঁছানো যায় গুলশান সড়কে। সময় ও খরচ বাঁচাতে বস্তিবাসী নৌকায় চলাচল করেন। শুধু বস্তির নিম্নবিত্ত মানুষই নন, ঐ এলাকায় বসবাসরত মধ্যবিত্ত মানুষজনও নৌকায় চড়েন সময় ও যাতায়াত খরচ বাঁচাতে।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীতে পাওয়া যায় বিশ্বমানের প্রায় সব সুযোগ সুবিধা। এই আভিজাত্যের বিপরীতেই মাত্র ২০ মিটারের একটা লেক পাড়ি দিলে ঢাকার সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত কড়াইল বস্তির অবস্থান। মাত্র ২০ মিটারের ব্যবধান হলেও একপাশে বসবাস করে বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ অপরদিকে সুবিধাবঞ্চিত লক্ষাধিক খেটে খাওয়া মানুষ।
গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার গা ঘেঁষে বাস করেও বিষণ্ন বিবর্ণ দারিদ্রক্লিষ্ট তাদের জীবন। অথচ এখান থেকে লেক পার হলেই উপচে পড়ছে বিত্তবানদের বিলাসবহুল জীবন। বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস আর নদীভাঙ্গনের শিকার হয়ে গ্রামে পিতৃপুরুষের ভিটে ছেড়ে কড়াইল বস্তিতে ঠাঁই নেওয়া মানুষগুলো অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে।
হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতেও তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে না মোটেই। এ যেন বাতির নিচে অন্ধকার। মূলত এই বস্তিটিতেই গুলশানের বিত্তবান বাসিন্দাদের গৃহকর্মী, মালি, নিরাপত্তারক্ষীর বসবাস করে। কড়াইল বস্তি থেকে গুলশানে যাওয়ার শর্টকাট বাহন হলো নৌকা। সড়কপথে টিঅ্যান্ডটি কলোনি পার হয়ে বস্তির মধ্য দিয়ে বেলতলা গলি ধরে পশ্চিম দিকে ঘুরে মূল সড়কে উঠতে সময় লাগে ৪০ মিনিটের বেশি।
অথচ নৌকায় মাত্র ৫ মিনিটেই পৌঁছানো যায় গুলশান সড়কে। সময় ও খরচ বাঁচাতে বস্তিবাসী নৌকায় চলাচল করেন।নৌকা পারাপার তাদের ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে পাশাপাশি খরচও কম। কড়াইল বস্তির বউবাজার ঘাট দিয়ে নৌকায় ৫ টাকায় গুলশানে পৌঁছাতে সময় লাগে ৫ মিনিট। সড়ক পথে সেই একই গন্তব্য ৪ কিলোমিটার দূরে এবং খরচ হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
কড়াইল বস্তির স্থায়ী এবং প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের শাসনামলে এলাকাটি টেলিগ্রাফ এন্ড টেলিফোন বোর্ড (টিএন্ডটি) বোর্ডের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল। তখন জায়গাটি ব্যক্তিগত মালিকানায় ছিল। এক্ষেত্রে ক্রয়ের কঠোর শর্তের কারনে জমিটি শুধু টিএন্ডটি ব্যবহার করতো। কিন্তু ১৯৯০ সালে মূল চুক্তির ব্যতয় ঘটিয়ে ৯০ একর জায়গা গণপূর্ত বিভাগকে (পিডব্লিউডি) বরাদ্দ দেওয়া হয়। যখন পিডব্লিউডি নতুন অধিগ্রহণ করা জমিতে কাজ শুরু করে, তখন মূল মালিকরা চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য টিএন্ডটি-এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়। আরও পড়ুনসীমান্তে ফের গুলিবর্ষণ বিএসএফেরতারা জমিটি আবারও ব্যক্তিমালিকানায় ফেরতের দাবি জানান।
এক্ষেত্রে আরও আইনি জটিলতা এড়াতে, টিএন্ডটি পিডব্লিউডি-কে দেওয়া ৯০ একর জমি ফেরত নেয়। যদিও জমির আয়তন নিয়ে বিরোধ রয়েছে। তবে তা ৯০ থেকে ৯৩ কিংবা ১১০ একরের মতো ছিল বলে জানা যায়। একইসঙ্গে তারা পিডব্লিউডির শুরু করা আগের উন্নয়ন কাজকে বেআইনি হিসাবে চিহ্নিত করে। মোটাদাগে আজকের কড়াইল বস্তি এলাকার স্টেকহোল্ডার মূলত তিনটি পক্ষ। যথা, টিএন্ডটি, পিডব্লিউডি এবং জমির প্রাক্তন ব্যক্তিগত মালিক।এদিকে ১৯৯০-এর দশকে টিএন্ডটির স্টাফ, গডফাদার ও ওয়ার্ড কমিশনাররা বেআইনিভাবে জমির নানা অংশ দখল করে। এই দখলকারী ব্যক্তিরা নিম্ন আয়ের ও দরিদ্র মানুষদেরকে কম টাকায় জমি ও ঘর ভাড়া দিতে শুরু করে।
এক্ষেত্রে সস্তা আবাসনের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলেই আজকের কড়াইল বস্তি তৈরি হয়েছে।নৌকা পারাপার তাদের ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে পাশাপাশি খরচও কম। কড়াইল বস্তির বউবাজার ঘাট দিয়ে নৌকায় ৫ টাকায় গুলশানে পৌঁছাতে সময় লাগে ৫ মিনিট। সড়ক পথে সেই একই গন্তব্য ৪ কিলোমিটার দূরে এবং খরচ হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা।কড়াইল বস্তিতে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ বাস করে। ২৪-২৫ বছর আগে যখন জঙ্গল পরিষ্কার করে বস্তি গড়ে ওঠে তখন থেকেই গুলশান লেক পারাপারের জন্য শুরু হয় নৌকার ব্যবহার। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বস্তির মানুষ বেড়েছে, পারাপারের যাত্রী বেড়েছে, বেড়েছে নৌকার সংখ্যা।
শনিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় গুলশান লেকের ঘাটে বাঁধা সারি সারি নৌকা। নিচে কুচকুচে কালো পঁচা পানি। পানির দুর্গন্ধে বিষিয়ে ওঠা বাতাস। অগত্যা অনেকেই নাক চেপেই নৌকায় উঠছেন। মহাখালী মোড় থেকে গুলশান এক নম্বরে যাওয়ার পথে রাস্তার বাঁয়েই এই কড়াইল খেয়াঘাট। আবার মহাখালী টিঅ্যান্ডটি কলোনি হয়ে রিকশা, সিএনজি বা মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়া যায়। তবে রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় বড় গাড়ি সেখানে যায় না। তবে তা ৪/৫ কিলোমিটার পথের দুরত্ব এবং পথের ব্যয় তুলনামূলক অনেক বেশি।
মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছোট ঘাট, বড় ঘাট, বাদলের ঘাট, মোমেনের ঘাটে প্রায় অর্ধশতাধিক মাঝি আছেন পারাপারের কাজে। মাঝিদের সহকারি আছেন ২০-৩০ জন। সহকারিরা বেশিরভাগই অল্প বয়সী। যাদের এখন স্কুল যাবার কথা। কিন্ত টানাটানির সংসারে অভাবের তাড়নায় এই শিশুদের এখানে কাজ করতে হয়। ঘাটে সকালে ও সন্ধ্যায় যাত্রীদের ভীড় লেগে থাকে। তবে দিনের অন্য সময়ে তেমন একটা ভিড় থাকে না। পারাপার চলে মধ্যরাত (১২ টা) পর্যন্ত।
এখানে বর্তমানে নৌকা রয়েছে ২০ টিরও বেশি। তবে এই মাঝিরা এসব নৌকার মালিক নন। দিন-চুক্তিতে ভাড়ায় চালাতে হয়। গড়ে প্রতিদিন ঘাট দিয়ে পারাপার হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার যাত্রী। তবে পুরো দিনের জন্য নৌকা জোটে না মাঝিদের কপালে।ফিরতি বেলায় নৌকা পেতে কাউকে কাউকে অলস বসে কাটাতে হয়। অন্যদিকে নৌকা জোটে মাত্র একবেলা আরেক বেলা ডাঙ্গায়। জনপ্রতি ভাড়া মাত্র ৫ টাকা। শুধুমাত্র নিজের ও পরিবারের পেটের ভাত জোটাতেই নৌকা চালানোর এই পেশা আঁকড়ে আছেন তারা। তবে কেউ কেউ গ্রাম থেকে রাজধানীতে এসে কোনো কাজ না পেয়ে মাঝি হয়েছেন গুলশান খেয়াঘাটে। এখানে অনেকেই জীবনের অনেকটা সময় পার করেছেন। অনেক শিক্ষিত মানুষ, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তারা তাদের দিন বদলের কথা বলেছেন কিন্তু দিন বদলের ছোঁয়া তাদের জীবনে একদমই লাগেনি।তার মতে, ’ভোটের সময় নেতারা যখন আসেন তখন তাদের গালভরা কথায় বুক ভরে যায়। ভোট শেষে আর কেউই আর বস্তির পথ মাড়ায় না।’কড়াইল বস্তি প্রধানত দুইটি অংশে বিভক্ত। এগুলো জামাইবাজার (ইউনিট ১) ও বউবাজার (ইউনিট ২) নামে পরিচিত। বউবাজারের মধ্যে চারটি ভাগ আছে; এগুলো ক, খ, গ ও ঘ নামে পরিচিত। এছাড়াও বৃহত্তর কড়াইল বস্তির অধীনে রয়েছে বেলতলা বস্তি, টিএন্ডটি বস্তি, বাইদার বস্তি, এরশাদনগর ও গোডাউন বস্তি। এছাড়াও পশ্চিমপাড়া, পূর্বপাড়া, দক্ষিণপাড়া ও উত্তরপাড়াও এর অংশ। জমি দখল ও বর্জ্য দিয়ে জলাশয় ভরাট করে বস্তির এলাকাটি ধীরে ধীরে গুলশান লেকের দিকে প্রসারিত হচ্ছে।কুড়িগ্রামের জেলার উলিপুরের ফকিরপাড়া গ্রামের নয়ন মিয়া ১৮ বছর আগে ঢাকা এসেছিলেন কাজের খোঁজে। অন্য কাজ না পেয়ে তার আগ থেকে ঢাকায় আসা তার বড়ভাইয়ের পেশা নৌকা চালানোর কাজে লেগে যান। সেই থেকে জীবনের পেশা হয়ে গেছে নৌকা চালানো।তিনি বলেন, ‘অনেক বছরই তো দেখলাম। আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। সরকার আমাদের জন্য কোন কিছু করার কথাও চিন্তা করে না। অল্প কামাই দিয়া তো ছাওপাওয়ের (ছেলেমেয়ের) লেখাপড়া করানোর ক্ষেমতা নাই। বস্তিতে ভাড়ায় থাকি। একটাকাও জমা হয় না। মেয়ে বড় হইছি বিয়া দেব কিভাবে সেই চিন্তায় দিন যায়।’তিনি আরও জানান, ২০১৬ সালে গুলশানে হোলি আর্টিজানে হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কড়াইল বস্তি ও গুলশানের মধ্যকার লেকে নৌকা চলাচল বন্ধ করে দেয়। ঐ সময়ে নৌকা বন্ধ থাকায় তিনি দিনমজুরের কাজ করেছিলেন। ২০২২ এর শুরুতে বস্তির বাসিন্দা কয়েকজন মাঝি আবার সেখানে পুনরায় নৌকায় যাত্রী পারাপার শুরু করেন।নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মাঝি যুগান্তরকে জানান, গত এক বছর ধরে তারা সরাসরি যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নিতে পারছেন না। নৌকার মালিকপক্ষ ঘাটের দুইপাড়ে তাদের কর্মী রেখেছেন। তারাই ভাড়া আদায় করছেন।তিনি আরও জানান, সেক্ষেত্রে একজন মাঝি দিনে প্রায় ৮০ থেকে ৯০টি ট্রিপ দিয়ে ৭৭৫ টাকা পান। অথচ, তাদের এই ট্রিপ থেকে অন্তত ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা আয় হয়। তিনি বলেন, ‘এর আগে আমরা ভাড়ার টাকা সংগ্রহ করে মালিকদের কাছে তুলে দিতাম। তখন ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা ভাড়া তুলে দিলেও মালিকরা প্রায় ৮০০ টাকা করে দিতেন।’নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ বিষয়ে একজন নৌকার মালিক জানান, নৌকা চলাচল সচল রাখতে বিভিন্ন কাজে অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বিশেষ করে বস্তির রাজনৈতিক নেতাদের অর্থ প্রদান, নৌকা মেরামত এবং ঘাট মেরামতে অনেক টাকা ব্যয় হয়। তাই মাঝিদের কম টাকা দিচ্ছেন তারা।আসলাম হোসেন নামের আরেকজন বাসিন্দা যুগান্তরকে জানান ১৯৮৮ নোয়াখালী থেকে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। তখন তার বিয়েও হয়নি। বস্তিবাসীরা বিভিন্ন জেলা থেকে শহরে এসেছিল। এদের মধ্যে প্রথম দিকের বাসিন্দারা কুমিল্লা জেলা থেকে এসেছিল। তাই সেই ক্লাস্টারটিকে 'কুমিল্লা পট্টি' নাম দেওয়া হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বরিশাল, ভোলা, শেরপুর, বরগুনা, চাঁদপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুরসহ অন্যান্য জেলা থেকে লোকজন আসতে শুরু করে। তারা জেলা অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রুপ গঠন করতে থাকে এবং কড়াইল বস্তিতে একসঙ্গে বসবাস করতে থাকে। আসলাম ও তার পরিবার গত ৩৭ বছর ধরে বস্তিটিতে বসবাস করছে।
আলামিন হোসেন ১৯৯৯ সালের শুরুতে কাজের সন্ধানে ভোলা থেকে ঢাকায় আসেন। তিনি বলেন, ‘আমি নৌকা আর নদীতে ঘেরা এলাকায় বড় হয়েছি। নৌকা চালানো আমার রক্তে মিশে আছে। এর আগে আমি এখানে নৌকার মাঝি হিসেবে কাজ করতাম। কাজের জন্য বস্তির লোকদের একদিক থেকে অন্য দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি নৌকা চালাতাম। তখন জনপ্রতি ভাড়া ছিল ২ টাকা। এখন নৌকা ভাড়া ৫ টাকা। তবে কষ্টের বিষয় গুলশান লেকের পানি পিচের মতো কালো। এটি থেকে আসা অসহনীয় দুর্গন্ধ খুব খারাপ লাগে।আলামিনের মতে, বরিশালের অপরুপ নদীগুলো কখনো দুর্গন্ধ ছড়ায় না। এখানে ৪০ জনের বেশি মাঝি কাজ করলেও কেউ নৌকার মালিক নয়। তাদের মালিকের সাথে চুক্তিতে নৌকা নিতে হয়। এক্ষেত্রে প্রতিদিন ৭৭৫ টাকা ভাড়া দিতে হবে। দেশে চোখের সামনে কত পরিবর্তনই না হয়েছে কিন্ত তাদের ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন হয়নি।
রাজধানীর দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, গার্মেন্টস শ্রমিক, দিনমজুর, গৃহকর্মী, রিকশাওয়ালাসহ কায়িক শ্রমজীবীদের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে এ বস্তিটি।সড়কপথে টিঅ্যান্ডটি কলোনি পার হয়ে বস্তির মধ্য দিয়ে বেলতলা গলি ধরে পশ্চিম দিকে ঘুরে মূল সড়কে উঠতে সময় লাগে ৪০ মিনিটের বেশি। অথচ নৌকায় মাত্র ৫ মিনিটেই পৌঁছানো যায় গুলশান সড়কে। সময় ও খরচ বাঁচাতে বস্তিবাসী নৌকায় চলাচল করেন। শুধু বস্তির নিম্নবিত্ত মানুষই নন, ঐ এলাকায় বসবাসরত মধ্যবিত্ত মানুষজনও নৌকায় চড়েন সময় ও যাতায়াত খরচ বাঁচাতে।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীতে পাওয়া যায় বিশ্বমানের প্রায় সব সুযোগ সুবিধা। এই আভিজাত্যের বিপরীতেই মাত্র ২০ মিটারের একটা লেক পাড়ি দিলে ঢাকার সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত কড়াইল বস্তির অবস্থান। মাত্র ২০ মিটারের ব্যবধান হলেও একপাশে বসবাস করে বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ অপরদিকে সুবিধাবঞ্চিত লক্ষাধিক খেটে খাওয়া মানুষ।
গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার গা ঘেঁষে বাস করেও বিষণ্ন বিবর্ণ দারিদ্রক্লিষ্ট তাদের জীবন। অথচ এখান থেকে লেক পার হলেই উপচে পড়ছে বিত্তবানদের বিলাসবহুল জীবন। বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস আর নদীভাঙ্গনের শিকার হয়ে গ্রামে পিতৃপুরুষের ভিটে ছেড়ে কড়াইল বস্তিতে ঠাঁই নেওয়া মানুষগুলো অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে।
হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতেও তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে না মোটেই। এ যেন বাতির নিচে অন্ধকার। মূলত এই বস্তিটিতেই গুলশানের বিত্তবান বাসিন্দাদের গৃহকর্মী, মালি, নিরাপত্তারক্ষীর বসবাস করে। কড়াইল বস্তি থেকে গুলশানে যাওয়ার শর্টকাট বাহন হলো নৌকা। সড়কপথে টিঅ্যান্ডটি কলোনি পার হয়ে বস্তির মধ্য দিয়ে বেলতলা গলি ধরে পশ্চিম দিকে ঘুরে মূল সড়কে উঠতে সময় লাগে ৪০ মিনিটের বেশি।
অথচ নৌকায় মাত্র ৫ মিনিটেই পৌঁছানো যায় গুলশান সড়কে। সময় ও খরচ বাঁচাতে বস্তিবাসী নৌকায় চলাচল করেন।নৌকা পারাপার তাদের ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে পাশাপাশি খরচও কম। কড়াইল বস্তির বউবাজার ঘাট দিয়ে নৌকায় ৫ টাকায় গুলশানে পৌঁছাতে সময় লাগে ৫ মিনিট। সড়ক পথে সেই একই গন্তব্য ৪ কিলোমিটার দূরে এবং খরচ হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
কড়াইল বস্তির স্থায়ী এবং প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের শাসনামলে এলাকাটি টেলিগ্রাফ এন্ড টেলিফোন বোর্ড (টিএন্ডটি) বোর্ডের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল। তখন জায়গাটি ব্যক্তিগত মালিকানায় ছিল। এক্ষেত্রে ক্রয়ের কঠোর শর্তের কারনে জমিটি শুধু টিএন্ডটি ব্যবহার করতো। কিন্তু ১৯৯০ সালে মূল চুক্তির ব্যতয় ঘটিয়ে ৯০ একর জায়গা গণপূর্ত বিভাগকে (পিডব্লিউডি) বরাদ্দ দেওয়া হয়। যখন পিডব্লিউডি নতুন অধিগ্রহণ করা জমিতে কাজ শুরু করে, তখন মূল মালিকরা চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য টিএন্ডটি-এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়। আরও পড়ুনসীমান্তে ফের গুলিবর্ষণ বিএসএফেরতারা জমিটি আবারও ব্যক্তিমালিকানায় ফেরতের দাবি জানান।
এক্ষেত্রে আরও আইনি জটিলতা এড়াতে, টিএন্ডটি পিডব্লিউডি-কে দেওয়া ৯০ একর জমি ফেরত নেয়। যদিও জমির আয়তন নিয়ে বিরোধ রয়েছে। তবে তা ৯০ থেকে ৯৩ কিংবা ১১০ একরের মতো ছিল বলে জানা যায়। একইসঙ্গে তারা পিডব্লিউডির শুরু করা আগের উন্নয়ন কাজকে বেআইনি হিসাবে চিহ্নিত করে। মোটাদাগে আজকের কড়াইল বস্তি এলাকার স্টেকহোল্ডার মূলত তিনটি পক্ষ। যথা, টিএন্ডটি, পিডব্লিউডি এবং জমির প্রাক্তন ব্যক্তিগত মালিক।এদিকে ১৯৯০-এর দশকে টিএন্ডটির স্টাফ, গডফাদার ও ওয়ার্ড কমিশনাররা বেআইনিভাবে জমির নানা অংশ দখল করে। এই দখলকারী ব্যক্তিরা নিম্ন আয়ের ও দরিদ্র মানুষদেরকে কম টাকায় জমি ও ঘর ভাড়া দিতে শুরু করে।
এক্ষেত্রে সস্তা আবাসনের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলেই আজকের কড়াইল বস্তি তৈরি হয়েছে।নৌকা পারাপার তাদের ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে পাশাপাশি খরচও কম। কড়াইল বস্তির বউবাজার ঘাট দিয়ে নৌকায় ৫ টাকায় গুলশানে পৌঁছাতে সময় লাগে ৫ মিনিট। সড়ক পথে সেই একই গন্তব্য ৪ কিলোমিটার দূরে এবং খরচ হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা।কড়াইল বস্তিতে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ বাস করে। ২৪-২৫ বছর আগে যখন জঙ্গল পরিষ্কার করে বস্তি গড়ে ওঠে তখন থেকেই গুলশান লেক পারাপারের জন্য শুরু হয় নৌকার ব্যবহার। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বস্তির মানুষ বেড়েছে, পারাপারের যাত্রী বেড়েছে, বেড়েছে নৌকার সংখ্যা।
শনিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় গুলশান লেকের ঘাটে বাঁধা সারি সারি নৌকা। নিচে কুচকুচে কালো পঁচা পানি। পানির দুর্গন্ধে বিষিয়ে ওঠা বাতাস। অগত্যা অনেকেই নাক চেপেই নৌকায় উঠছেন। মহাখালী মোড় থেকে গুলশান এক নম্বরে যাওয়ার পথে রাস্তার বাঁয়েই এই কড়াইল খেয়াঘাট। আবার মহাখালী টিঅ্যান্ডটি কলোনি হয়ে রিকশা, সিএনজি বা মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়া যায়। তবে রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় বড় গাড়ি সেখানে যায় না। তবে তা ৪/৫ কিলোমিটার পথের দুরত্ব এবং পথের ব্যয় তুলনামূলক অনেক বেশি।
মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছোট ঘাট, বড় ঘাট, বাদলের ঘাট, মোমেনের ঘাটে প্রায় অর্ধশতাধিক মাঝি আছেন পারাপারের কাজে। মাঝিদের সহকারি আছেন ২০-৩০ জন। সহকারিরা বেশিরভাগই অল্প বয়সী। যাদের এখন স্কুল যাবার কথা। কিন্ত টানাটানির সংসারে অভাবের তাড়নায় এই শিশুদের এখানে কাজ করতে হয়। ঘাটে সকালে ও সন্ধ্যায় যাত্রীদের ভীড় লেগে থাকে। তবে দিনের অন্য সময়ে তেমন একটা ভিড় থাকে না। পারাপার চলে মধ্যরাত (১২ টা) পর্যন্ত।
এখানে বর্তমানে নৌকা রয়েছে ২০ টিরও বেশি। তবে এই মাঝিরা এসব নৌকার মালিক নন। দিন-চুক্তিতে ভাড়ায় চালাতে হয়। গড়ে প্রতিদিন ঘাট দিয়ে পারাপার হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার যাত্রী। তবে পুরো দিনের জন্য নৌকা জোটে না মাঝিদের কপালে।ফিরতি বেলায় নৌকা পেতে কাউকে কাউকে অলস বসে কাটাতে হয়। অন্যদিকে নৌকা জোটে মাত্র একবেলা আরেক বেলা ডাঙ্গায়। জনপ্রতি ভাড়া মাত্র ৫ টাকা। শুধুমাত্র নিজের ও পরিবারের পেটের ভাত জোটাতেই নৌকা চালানোর এই পেশা আঁকড়ে আছেন তারা। তবে কেউ কেউ গ্রাম থেকে রাজধানীতে এসে কোনো কাজ না পেয়ে মাঝি হয়েছেন গুলশান খেয়াঘাটে। এখানে অনেকেই জীবনের অনেকটা সময় পার করেছেন। অনেক শিক্ষিত মানুষ, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তারা তাদের দিন বদলের কথা বলেছেন কিন্তু দিন বদলের ছোঁয়া তাদের জীবনে একদমই লাগেনি।তার মতে, ’ভোটের সময় নেতারা যখন আসেন তখন তাদের গালভরা কথায় বুক ভরে যায়। ভোট শেষে আর কেউই আর বস্তির পথ মাড়ায় না।’কড়াইল বস্তি প্রধানত দুইটি অংশে বিভক্ত। এগুলো জামাইবাজার (ইউনিট ১) ও বউবাজার (ইউনিট ২) নামে পরিচিত। বউবাজারের মধ্যে চারটি ভাগ আছে; এগুলো ক, খ, গ ও ঘ নামে পরিচিত। এছাড়াও বৃহত্তর কড়াইল বস্তির অধীনে রয়েছে বেলতলা বস্তি, টিএন্ডটি বস্তি, বাইদার বস্তি, এরশাদনগর ও গোডাউন বস্তি। এছাড়াও পশ্চিমপাড়া, পূর্বপাড়া, দক্ষিণপাড়া ও উত্তরপাড়াও এর অংশ। জমি দখল ও বর্জ্য দিয়ে জলাশয় ভরাট করে বস্তির এলাকাটি ধীরে ধীরে গুলশান লেকের দিকে প্রসারিত হচ্ছে।কুড়িগ্রামের জেলার উলিপুরের ফকিরপাড়া গ্রামের নয়ন মিয়া ১৮ বছর আগে ঢাকা এসেছিলেন কাজের খোঁজে। অন্য কাজ না পেয়ে তার আগ থেকে ঢাকায় আসা তার বড়ভাইয়ের পেশা নৌকা চালানোর কাজে লেগে যান। সেই থেকে জীবনের পেশা হয়ে গেছে নৌকা চালানো।তিনি বলেন, ‘অনেক বছরই তো দেখলাম। আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। সরকার আমাদের জন্য কোন কিছু করার কথাও চিন্তা করে না। অল্প কামাই দিয়া তো ছাওপাওয়ের (ছেলেমেয়ের) লেখাপড়া করানোর ক্ষেমতা নাই। বস্তিতে ভাড়ায় থাকি। একটাকাও জমা হয় না। মেয়ে বড় হইছি বিয়া দেব কিভাবে সেই চিন্তায় দিন যায়।’তিনি আরও জানান, ২০১৬ সালে গুলশানে হোলি আর্টিজানে হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কড়াইল বস্তি ও গুলশানের মধ্যকার লেকে নৌকা চলাচল বন্ধ করে দেয়। ঐ সময়ে নৌকা বন্ধ থাকায় তিনি দিনমজুরের কাজ করেছিলেন। ২০২২ এর শুরুতে বস্তির বাসিন্দা কয়েকজন মাঝি আবার সেখানে পুনরায় নৌকায় যাত্রী পারাপার শুরু করেন।নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মাঝি যুগান্তরকে জানান, গত এক বছর ধরে তারা সরাসরি যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নিতে পারছেন না। নৌকার মালিকপক্ষ ঘাটের দুইপাড়ে তাদের কর্মী রেখেছেন। তারাই ভাড়া আদায় করছেন।তিনি আরও জানান, সেক্ষেত্রে একজন মাঝি দিনে প্রায় ৮০ থেকে ৯০টি ট্রিপ দিয়ে ৭৭৫ টাকা পান। অথচ, তাদের এই ট্রিপ থেকে অন্তত ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা আয় হয়। তিনি বলেন, ‘এর আগে আমরা ভাড়ার টাকা সংগ্রহ করে মালিকদের কাছে তুলে দিতাম। তখন ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা ভাড়া তুলে দিলেও মালিকরা প্রায় ৮০০ টাকা করে দিতেন।’নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ বিষয়ে একজন নৌকার মালিক জানান, নৌকা চলাচল সচল রাখতে বিভিন্ন কাজে অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বিশেষ করে বস্তির রাজনৈতিক নেতাদের অর্থ প্রদান, নৌকা মেরামত এবং ঘাট মেরামতে অনেক টাকা ব্যয় হয়। তাই মাঝিদের কম টাকা দিচ্ছেন তারা।আসলাম হোসেন নামের আরেকজন বাসিন্দা যুগান্তরকে জানান ১৯৮৮ নোয়াখালী থেকে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। তখন তার বিয়েও হয়নি। বস্তিবাসীরা বিভিন্ন জেলা থেকে শহরে এসেছিল। এদের মধ্যে প্রথম দিকের বাসিন্দারা কুমিল্লা জেলা থেকে এসেছিল। তাই সেই ক্লাস্টারটিকে 'কুমিল্লা পট্টি' নাম দেওয়া হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বরিশাল, ভোলা, শেরপুর, বরগুনা, চাঁদপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুরসহ অন্যান্য জেলা থেকে লোকজন আসতে শুরু করে। তারা জেলা অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রুপ গঠন করতে থাকে এবং কড়াইল বস্তিতে একসঙ্গে বসবাস করতে থাকে। আসলাম ও তার পরিবার গত ৩৭ বছর ধরে বস্তিটিতে বসবাস করছে।
আলামিন হোসেন ১৯৯৯ সালের শুরুতে কাজের সন্ধানে ভোলা থেকে ঢাকায় আসেন। তিনি বলেন, ‘আমি নৌকা আর নদীতে ঘেরা এলাকায় বড় হয়েছি। নৌকা চালানো আমার রক্তে মিশে আছে। এর আগে আমি এখানে নৌকার মাঝি হিসেবে কাজ করতাম। কাজের জন্য বস্তির লোকদের একদিক থেকে অন্য দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি নৌকা চালাতাম। তখন জনপ্রতি ভাড়া ছিল ২ টাকা। এখন নৌকা ভাড়া ৫ টাকা। তবে কষ্টের বিষয় গুলশান লেকের পানি পিচের মতো কালো। এটি থেকে আসা অসহনীয় দুর্গন্ধ খুব খারাপ লাগে।আলামিনের মতে, বরিশালের অপরুপ নদীগুলো কখনো দুর্গন্ধ ছড়ায় না। এখানে ৪০ জনের বেশি মাঝি কাজ করলেও কেউ নৌকার মালিক নয়। তাদের মালিকের সাথে চুক্তিতে নৌকা নিতে হয়। এক্ষেত্রে প্রতিদিন ৭৭৫ টাকা ভাড়া দিতে হবে। দেশে চোখের সামনে কত পরিবর্তনই না হয়েছে কিন্ত তাদের ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন হয়নি।