হাশরের ময়দান যখন থাকবে লোকে লোকারণ্য। লোকদের দাঁড়ানোর জায়গা হবে অতি সঙ্কীর্ণ। সেখানে চল্লিশ হাজার বছর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। দশ হাজার বছরে বিচার করা হবে।
তারা এর মধ্যে কোনো কথা বলতে পারবে না। (তাফসীরে ইবনু কাসির ১৮/৮৩) সেদিন সূর্য থাকবে মাত্র এক মাইল উপরে। ওর তাপ এত তীব্র ও প্রকট হবে যে, মাথার মগজ টগবগ করে ফুটতে থাকবে, যেমন প্রচণ্ড তাপের কারণে চুলার উপর রাখা হাঁড়ির পানি ফুটতে থাকে। সেই দিন সকল মানুষ নগ্নপায়ে, নগ্নদেহে খাতনাবিহীন অবস্থায় সমবেত হবে।
সেই দিন হবে অন্ধকারাচ্ছন্ন, নানা বিপদ-বিভীষিকাময় আপদে পরিপূর্ণ। এমন মহাবিপদসঙ্কুল দিবসে সূর্যের তীব্র ও প্রখর তাপ থেকে বাঁচার জন্য মানুষ ছায়া খুঁজবে কিন্তু কোনোই লাভ হবে না। তবে মহান আল্লাহ মাত্র সাত শ্রেণীর মানুষকে তাঁর আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। নিচের হাদিসে সেই সাত শ্রেনির বিবরণ পেশ করা হয়েছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَوْ عَنْ أَبِي سَعِيدٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ إِمَامٌ عَادِلٌ وَشَابٌّ نَشَأَ بِعِبَادَةِ اللَّهِ وَرَجُلٌ كَانَ قَلْبُهُ مُعَلَّقًا بِالْمَسْجِدِ إِذَا خَرَجَ مِنْهُ حَتَّى يَعُودَ إِلَيْهِ وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِي اللَّهِ فَاجْتَمَعَا عَلَى ذَلِكَ وَتَفَرَّقَا وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ حَسَبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ " .
আবূ হুরাইরা (রাঃ) অথবা আবূ সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আল্লা (কিয়ামত দিবসে) সাত প্রকারের লোককে তার (আরশের) ছায়াতলে আশ্রয় প্রদান করবেন, যেদিন তার (আরশের) ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়াই (আশ্রয়) অবশিষ্ট থাকবে না।
(তারা হলো)
(১) ন্যায়পরায়ণ শাসক,
(২) যে যুবক আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাতের মধ্যে বড় হয়েছে,
(৩) যে ব্যক্তি মাসজিদ হতে বেরিয়ে গেলেও তার অন্তর এর সাথে সম্পৃক্ত থাকে, যে পর্যন্ত না সে আবার সেখানে ফিরে আসে,
(৪) এমন দু’ব্যক্তি যারা আল্লাহ্ তা’আলার জন্য পরস্পর ভালোবাসা স্থাপন করেছে, এই সম্পর্কেই একত্র থাকে এবং বিচ্ছিন্ন হয়,
(৫) যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহ্ তা’আলাকে স্মরণ করেছে এবং তার দুচোখ বেয়ে পানি পড়েছে,
(৬) এমন ব্যক্তি যাকে কোন অভিজাত পরিবারের সুন্দরী রূপসী নারী (অশ্লীল কাজে) আহববান করেছে কিন্তু সে তাকে এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছেঃ আমি আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় করি এবং
(৭) এমন ব্যক্তি যে এত গোপনে দান-খাইরাত করেছে যে, তার বাম হাতও জানতে পারেনি যে, তার ডান হাত কি দান করেছে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৯১)
হাদিসের ব্যাখ্যা
এই হাদিসে কিয়ামতের দিনের এক বিশেষ মুহর্তে সাত শ্রেণির মানুষের আল্লাহর আরশের ছায়া লাভ করার কথা বলা হয়েছে। কিয়ামতের দিনকার পরিবেশ এমন ভয়াবহ হবে যে, মানুষের জন্য ছায়া, নিরাপত্তা ও প্রশান্তি হবে সবচেয়ে মূল্যবান অবলম্বন। সে দিনের প্রখরতা, দুশ্চিন্তা, দীর্ঘ অপেক্ষা এবং বিচারভীতির মধ্যে আল্লাহ তাআলা এই সাত শ্রেণির মানুষকে বিশেষ অনুগ্রহে আচ্ছাদিত করবেন। সেই সাত শ্রেণি হচ্ছে-
১. ন্যায়পরায়ণ শাসক
ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা শুধু শাসকের দায়িত্বই নয়; বরং তার ইমানদারিরও পরিচায়ক।
ক্ষমতা মানুষকে সহজেই অত্যাচার ও স্বার্থপরতার দিকে টেনে নেয়; তাই ক্ষমতার আসনে থেকেও ন্যায়পরায়ণ থাকা আল্লাহর নিকট অত্যন্ত প্রিয়। এখানে শাসক বলে শুধুমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান বুঝানো হয়নি । বরং যেকোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, যেমন শিক্ষক, জমিদার, নেতাসহ সকলেই যদি অন্যায না করে ন্যায় অনুসরণ করেন তাহলে তিনি এই মর্যাদায় অংশীদার হতে পারেন।
২. যে যুবক আল্লাহর ইবাদতে বড় হয়েছে
যৌবন হলো শক্তি ও প্রবৃত্তির সময়। এ বয়সে মানুষ সহজেই পাপের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই যে যুবক এই প্রলোভনের সময়ে, শক্তি ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর আনুগত্যে জীবন গড়ে তোলে; সে আল্লাহর বিশেষ প্রেমের অধিকারী। তার ইবাদত ও আনুগত্যের মূল্য আল্লাহর নিকট অনেক বেশি।
৩. যার হৃদয় মসজিদের সঙ্গে সংযুক্ত
এখানে সেই ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে, যার অন্তর মসজিদের প্রতি এমন আকর্ষণ অনুভব করে যে বাইরে থাকলেও সে মসজিদে ফেরার অপেক্ষা করে। এটি কেবল নামাজ পড়া নয়; বরং মসজিদকে জীবনের কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করা; আল্লাহর ঘরকে ভালোবাসা, সেখানে শান্তি পাওয়া এবং ঈমানের পরিবেশে নিজেকে সঁপে দেওয়ার মানসিকতার কথা বুঝানো হয়েছে।
৪. দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর জন্য পরস্পর ভালোবাসে
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বন্ধুত্ব স্থাপন করা এক বিশেষ ইমানীয় সম্পর্ক। এ ভালোবাসা স্বার্থ, বংশ, উপকার কিংবা লোভের উপর নির্ভর করে না। তারা একত্র হয় আল্লাহর জন্য, বিচ্ছিন্নও হয় আল্লাহর জন্য। এ ধরনের মানসিকতা মাহন আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। তাই তাদের এই আল্লাহর জন্য পারস্পরিক মহব্বত আখিরাতে অসাধারণ মর্যাদার কারণ হবে।
৫. যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে চোখের পানি ফেলে
এটি আন্তরিকতার সর্বোচ্চ প্রকাশ। গোপন অবস্থায়, নির্জনে, মানুষের দৃষ্টি ও প্রশংসার বাইরে আল্লাহকে স্মরণ করলে যে কান্না আসে; তা হৃদয়ের পরিশুদ্ধতার নিদর্শন। এ কান্নার মূল্য আল্লাহর কাছে অনেক বেশি। এটি সেই ভয়, প্রেম ও বিনয় যা কেবল সত্যিকারের মু’মিনের হৃদয়ে জন্মায়। সে জন্য এর প্রতিদান হিসেবে সে হাশরের ভয়াবহ সময়ে আরশের নিছে আশ্রয় পাবে।
৬. যে ব্যক্তি পাপের আহ্বান সত্ত্বেও আল্লাহ-ভীতিতে নিজেকে সংযত রাখে
এ শ্রেণির ব্যক্তির পরীক্ষা অত্যন্ত কঠিন। প্রলোভন যখন সম্মানী, রূপসী, উচ্চবংশীয় কারও মাধ্যমে আসে এবং সুযোগ যখন পুরোপুরি হাতের মুঠোয়; ইচ্ছে করলেই কোনো বাধঅ ছাড়া নিচের কামনা-বাসনা চরিতার্ত্র করা যায়। সেই মুহুর্তে ‘আমি আল্লাহকে ভয় করি’ বলে তা থেকে বিরত থাকা খুব বড় ইবাদত। যা নফস, প্রবৃত্তি, সামাজিক লোভ; সবকিছুকে পরাভূত করার নাম। এটি খূব কম মানুষের পক্ষেই সম্ভব। তার বিনিময়ে তার জন্য মিলবে এই মহাপ্রাপ্তি।
৭. যে ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে তার বাম হাতও জানতে পারে না ডান হাত কী দান করেছে
এটি দানের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা। তোষামুদ, প্রচার, ছবি তোলা, মানুষের প্রশংসা; এসব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যে ব্যক্তি গোপনে দান করে, সে সেই ইখলাস অর্জন করে যা আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয়। তার দান অন্যের দৃষ্টির জন্য নয়; শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
হাদিসটি মানবজীবনের সাতটি আদর্শ চরিত্র তুলে ধরে; ন্যায়, আনুগত্য, মসজিদের প্রতি ভালোবাসা, নৈতিক বন্ধুত্ব, আন্তরিকতা, পাপ থেকে দূরে থাকা এবং গোপন দান। হাশরের ময়দানের ভয়াবহতার সময়ে এ চরিত্রগুলো মানুষকে আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান দেবে; যা মানবতার সর্বোচ্চ সম্মানগুলোর একটি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক