ব্যাংকে মুদারাবা পদ্ধতিতে টাকা রেখে সেই মুনাফায় সংসার চালানো যাবে কি?
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:১০ এএম
মুদারাবা ইসলামিক আর্থিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি, যেখানে এক পক্ষ মূলধন প্রদান করে (রাবুল-মাল) এবং অন্য পক্ষ শ্রম ও ব্যবস্থাপনা প্রদান করে (মুদারিব)। এই যৌথ উদ্যোগ থেকে অর্জিত লাভ পূর্বনির্ধারিত অনুপাত অনুযায়ী উভয় পক্ষের মধ্যে বণ্টন করা হয়, যা ‘মুদারাবা মুনাফা’ নামে পরিচিত। এতে সুদমুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত আর্থিক লেনদেন নিশ্চিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকগুলোতে প্রচলিত মুদারাবা পদ্ধতি এবং এর মুনাফায় সংসার চালানো কি বৈধ হবে?
অনেক আলেম বলেন, ইসলামি ব্যংকে মুদারাবা ব্যবসায় শেয়ার নেওয়া বা টাকা বিনিয়োগ করা বৈধ নয়। কারণ সেখানে লভ্যাংশ নির্ধারিত না থাকলেও ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা বা অপশন নেই। অথচ ব্যবসায় লাভ-লোকসান দুটোই থাকে। এদেশের ইসলামি ব্যাংকগুলো ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেনের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ শরিয়া পদ্ধতি অনুসরণ করে না। ফলে ইসলামি ব্যাংকের লেনদেন থেকে আয়কৃত মুনাফা সন্দেহমুক্ত নয়। অতএব ইসলামি ব্যাংকসহ সব ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন থেকে বেঁচে থাকা জরুরি এবং এটিই দ্বীন ও ঈমানের জন্য নিরাপদ। কেননা একজন মুমিনের জীবনে হালাল হারামের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাদিসে পাকে এসেছে—
إِنَّ الْحَلاَلَ بَيِّنٌ وَإِنَّ الْحَرَامَ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لاَ يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ
‘নিশ্চয়ই হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। উভয়ের মাঝে রয়েছে বহু সন্দেহজনক বিষয়, অনেক লোকই সেগুলো জানে না। যে ব্যক্তি এসব সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকে সে তার দীন ও মর্যাদাকে নিরাপদে রাখে। আর যে লোক সন্দেহজনক বিষয়ে পতিত হবে, সে হারামের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়বে।’ (মুসলিম ৩৯৪৯)
সুতরাং ইসলামি ব্যাংকসমূহের মুদারাবার ব্যাপারে নসিহাহ হলো— ব্যাংকের সঙ্গে মুআমালা না করা। যদি কেউ মুদারাবা লেনদেনে জড়িয়ে থাকেন তবে তা বিলম্ব না করে গুটিয়ে নেওয়া। আর ব্যাংক থেকে আয়কৃত মুনাফা ছাওয়াবের নিয়ত ছাড়া গরীব মিসকিনদের মাঝে দান করে দেওয়া। মুসলিমদের কোনো জনকল্যাণমূলক কাজেও দান করা যাবে। যদি জিহাদের পথে খরচ করার সুযোগ থাকে তবে তা আরও উত্তম। কেননা শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন—
এমন অর্থ থেকে মুক্তি লাভের উত্তম পথ হচ্ছে, তা জিহাদের পথে খরচ করা। তিনি বলেন—
ومن أراد التخلص من الحرام والتوبة ولا يمكن رده إلى أصحابه فلينفقه في سبيل الله عن أصحابه فإن ذلك طريق حسنة إلى خلاصه مع ما يحصل له من أجر الجهاد
‘যে ব্যক্তি হারাম থেকে দায়মুক্ত হয়ে চায় এবং তওবা করতে চায়; অথচ তা মালিকের কাছে পৌঁছানো সম্ভবপর নয়, তাহলে সে যেন তা মালিকের পক্ষ থেকে জিহাদের পথে খরচ করে। এটা দায়মুক্তির উত্তম পথ এবং এতে সে জিহাদে অংশ গ্রহণেরও ছাওয়াব পাবে।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া ২৮/৪২১-৪২২, ফাতাওয়া উসমানি ৩/২৭৬, ১২৮-১৪০)
তবে মুদারাবা কারবারের মাধ্যমে মুনাফা কতটুকু শরীয়ত সম্মত? এ বিষয়ে বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলারদের আরও একটি মতামত আছে যে— যদিও কেউ মুদরাবা পদ্ধতিতে মুনাফা বিনিয়োগে অংশ নেয় তবে তার উচিত, ‘পার্সেন্ট হিসেবে যতটুকু উভয় চুক্তিকারী সম্মত হয়, ততটুকু মুনাফা গ্রহণই জায়েজ আছে। এখানে কোন পরিমাণ নির্দিষ্ট নেই। বাকি মুনাফার পার্সেন্ট উভয় চুক্তিকারীর সম্মতিক্রমে হতে হবে। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বা বস্তু নির্দিষ্ট করা বৈধ নয়। যেমন— টাকা প্রদানকারী এ কথা বলল যে, লাভের ৫০/৬০/৭০ পার্সেন্ট আমাকে দিতে হবে। এতে উভয় চুক্তিকারী সম্মত হল। তাহলে চুক্তিকৃত মুনাফার অর্থ দাতা পাবে, আর বাকিটা পাবে মুদারিব। কিন্তু যদি একথা বলে যে, লভ্যাংশ থেকে ৫ হাজার টাকা আমাকে দিতে হবে। অর্থাৎ পার্সেন্ট নির্দিষ্ট না করে পরিমাণ নির্দিষ্ট করে, তাহলে উক্ত চুক্তি বৈধ হবে না।
যেখানে বাংলাদেশের ইসলামি ব্যাংকগুলোতে প্রচলিত মুদারাবার মুনাফায় সন্দেহ আছে সেখানে এ টাকায় সংসার চালানো বা এ পদ্ধতির সঙ্গে লেনদেন করা কোনোটিই বৈধ নয়।
তবে মুদারাবা মুনাফা ইসলামি অর্থনীতির মূল নীতিগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক ন্যায়ভিত্তিক লাভ বণ্টন পদ্ধতি। এখানে ঝুঁকি ও মুনাফা উভয়ই স্বচ্ছভাবে ভাগ করা হয়, যা পক্ষগুলোর মধ্যে আস্থা বৃদ্ধি করে এবং বাস্তব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করে। ফলে মুদারাবা চুক্তি আধুনিক ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে একটি কার্যকর ও জনপ্রিয় লাভ-বণ্টন ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত। যখনে এটি পরিপূর্ণভাবে সঠিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে তখন এ পদ্ধতির মুনাফার টাকায় সংসার পরিচালনা করা বৈধ হবে।