মানুষের জীবনে দুটি জিনিস এমন আছে, যেগুলোর মূল্য আমরা হারিয়ে না ফেলা পর্যন্ত সত্যিই বুঝতে পারি না, তাহলো— সময় এবং সুস্থতা। নিদ্রাহীন রাত, শরীরের ব্যথা, শ্বাস নিতে কষ্ট— এসব মুহূর্তে মানুষ বুঝতে পারে সুস্থতা আসলে কত বড় নেয়ামত। আল্লাহ তাআলা মানুষের ওপর অসংখ্য নেয়ামত বর্ষণ করেছেন; কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান নেয়ামত হলো— সুস্থ শরীর, শান্ত মন এবং স্বাভাবিক জীবন। কারণ সুস্থতা থাকলে ইবাদত সহজ হয়, রিজিক হালালভাবে উপার্জন সহজ হয়, পরিবার–পরিজনের যত্ন নেওয়া সহজ হয় এবং জীবনকে আল্লাহর পথে পরিচালনা করা সহজ হয়। সুস্থতা মহান আল্লাহর অমূল্য নেয়ামত; বিষয়টি কুরআন-হাদিসে সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠেছে—
কুরআনের আলোকে সুস্থতার নেয়ামত
১. আল্লাহর নিয়ামতের স্মরণ
আল্লাহ তাআলা অগণতি-অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে সুস্থতা একটি। তার নেয়ামত গুণে শেষ করা যাবে না। এ বিষয়টি আল্লাহ তাআলা কুরআনে এভাবে ঘোষণা দেন—
وَإِن تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا ۗ
‘তোমরা যদি আল্লাহর নেয়ামতগুলো গণনা করতে চাও—তবে কখনই সেগুলোর হিসাব শেষ করতে পারবে না।’ (সুরা ইবরাহিম: আয়াত ৩৪)
২. আল্লাহ সুস্থতা ও কল্যাণ চান
সহজতা ও সুস্থতা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের নিদর্শন। আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য সব কিছুতেই সহজতা ও কল্যাণ কামনা করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন—
يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ
‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান, কষ্ট চান না।’ (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ১৮৫)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন—
فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا - إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا
‘অতঃপর নিশ্চয় কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি। নিশ্চয় কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি।’ (সুরা ইনশিরাহ: আয়াত ৫-৬)
মানুষের জীবনে স্বস্তি সুস্থতার একটি অংশ। স্বস্তিই মানুষের জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি এনে দেয়।
হাদিসের আলোকে সুস্থতার মর্যাদা
৩. সুস্থতা: হারানোর পর যার মূল্য জানা যায়
সুস্থতা হারিয়ে গেলে তার মূল্য বুঝা যায়। মানুষ সুস্থ থাকা অবস্থায় এর গুরুত্ব খুব কমই বুঝতে পারে। সুস্থতা বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ: الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ
‘দুটি নেয়ামত আছে, অনেক মানুষ এগুলোর মূল্য অনুধাবন করে না— সুস্থতা এবং অবসর সময়।’ (বুখারি ৬৪১২)
৪. সুস্থতার জন্য দোয়া— আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়
সুস্থতা এত বড় নেয়ামত যে নবীজি (সা.) আল্লাহর কাছে সব সময় এটিই (সুস্থতা) চাইতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে চাইতে বলেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেছেন—
قَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى الْمِنْبَرِ ثُمَّ بَكَى فَقَالَ: «سَلُوا اللَّهَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فَإِنَّ أَحَدًا لَمْ يُعْطَ بَعْدَ الْيَقِينِ خَيْرًا مِنَ الْعَافِيَةِ
‘রাসুলুল্লাহ (সা.) একদিন মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেললেন অতঃপর বললেন— তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং সুস্থতা প্রার্থনা করো। কেননা ইমান আনার পর কাউকেও সুস্থতার চেয়ে উত্তম আর কিছু দেওয়া হয় না।’ (তিরমিজি ৩৫৫৮, ইবনু মাজাহ ৩৮৪৯, মিশকাত ২৪৮৯)
৫. প্রতিনিয়ত মানুষের প্রকৃত সম্পদ—সুস্থতা
সুস্থতা এত বড় নেয়ামত যে, তা যেন পুরো দুনিয়া পাওয়ার মতো সৌভাগ্য। বিষয়টি রাসুলুল্লাহ (সা.) এভাবে উপস্থাপন করেছেন—
مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمْ مُعَافًى فِي جَسَدِهِ، آمِنًا فِي سِرْبِهِ، عِنْدَهُ قُوتُ يَوْمِهِ، فَكَأَنَّمَا حِيزَتْ لَهُ الدُّنْيَا
‘তোমাদের মধ্যে যে লোক পরিবার-পরিজনসহ নিরাপদে সকালে উপনীত হয়, সুস্থ শরীরে দিনাতিপাত করে এবং তার কাছে সারা দিনের খোরাকী থাকে তবে তার জন্য যেন গোটা দুনিয়াটাই একত্র করা হলো।’ (তিরমিজি ২৩৪৬, ইবনে মাজাহ ৪১৪১)
সুস্থতা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ
বিশেষ করে সুস্থতা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণগুলো হলো—
> সুস্থ শরীর ও মন নিয়ে ইবাদত করতে সহজ হয়
> সৎ কাজ সহজ হয়
> দুনিয়ার দায়িত্ব পালন সম্ভব হয়
> মনের প্রশান্তি আসে
> শোকর আদায় ও আনন্দময় জীবনযাপন সম্ভব
> পরিবার-সমাজের প্রতি দায়িত্বে উন্নতি হয়
সুস্থতা হলো জীবনের গতি, কাজের শক্তি এবং ইবাদতের সৌন্দর্য। তাই সুস্থ থাকার জন্য নিয়মিত আল্লাহর কাছে দোয়া করা। আর এটি সুন্নতও বটে। কেননা নবীজি (সা.) আল্লাহর কাছে সুস্থতার জন্য দোয়া করতে বলেছেন। সুতরাং আমরা আল্লাহর কাছে এভাবে দায়া করি—
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَافِيَةَ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল আফিয়াতা ফিদ দুনইয়া ওয়াল আখিরাহ।’
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে দুনিয়া ও আখিরাতে পূর্ণ সুস্থতা প্রার্থনা করছি।’
সুস্থতা হলো এক মহানেয়ামত, যাকে শব্দে বর্ণনা করা যায় না—কিন্তু হারালে হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সুস্থতার জন্য রাত-দিন কষ্ট করেন ডাক্তার, পরিবার, মানুষ; কিন্তু সুস্থতা দেওয়ার ক্ষমতা কেবল একজনেরই হাতে, তিনি হলেন মহান আল্লাহ। তাই প্রতিটি নিশ্বাসে, প্রতিটি সকালের আলোয়, প্রতিটি ব্যথাহীন হাঁটাহাটিতে আমাদের বলা উচিত— ‘আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ আমাকে সুস্থ রেখেছেন।’
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবার জীবনে সুস্থতা, নিরাপত্তা ও শান্তির নিয়ামতে পরিপূর্ণ করুন। آمين يا رب العالمين