Logo
Logo
×

ইসলাম

ভূমিকম্প কি আল্লাহর গজব? কুরআন ও হাদিসের আলোকে ভূমিকম্পের কারণ

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:২৪ পিএম

ভূমিকম্প কি আল্লাহর গজব? কুরআন ও হাদিসের আলোকে ভূমিকম্পের কারণ

মানুষ যতই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উন্নতির পথে অগ্রসর হোক, পৃথিবীর গভীরের অদৃশ্য কম্পন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আমরা সৃষ্টিকর্তার সামনে কত অসহায়। ভূমিকম্প সেই মুহূর্তের নাম, যখন আকাশ–পাতাল কেঁপে ওঠে আর মানুষের সব অহংকার ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। মনে প্রশ্ন জাগে— ভূমিকম্প কি আল্লাহর গজব? ইসলাম এ সম্পর্কে কী বলে?

কুরআন–হাদিসে ভূমিকম্পকে কেবল শাস্তি নয়, বরং সতর্কবার্তা, পরীক্ষা এবং সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতার নিদর্শন হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। আসুন— কুরআন–হাদিসের আলোকে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝে নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে এই বিপদ কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, বরং এটি আমাদের জন্য গভীর সতর্কবার্তা ও আল্লাহর পরীক্ষা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَنَبۡلُوَنَّكُمۡ بِشَیۡءٍ مِّنَ الۡخَوۡفِ وَ الۡجُوۡعِ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَنۡفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ ؕ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیۡنَ

‘আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা ও ক্ষতি দিয়ে এবং প্রাণহানি ও সম্পত্তি এবং ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে পরীক্ষা করব। আর আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন।’ (সুরা বাকারা , আয়াত : ১৫৫)

কুরআনের দৃষ্টিতে ভূমিকম্প

১. ভূমিকম্প কখনো শাস্তি (গজব)

কিছু জাতি তাদের অবাধ্যতার কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়েছে। তাদের অন্যতম সামুদ জাতি। আল্লাহ তাআলা কুরআনে সে ঘটনা এভাবে উল্লেখ করেছেন-

فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُوا فِي دَارِهِمْ جَاثِمِينَ

‘অতঃপর ভূমিকম্প তাদের গ্রাস করল, আর তারা নিজ গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।’ (সুরা আল-আরাফ: আয়াত ৭৮)

কুরআনুল কারিমের এই আয়াতে থেকে বোঝা যায়— আল্লাহ কিছু অবাধ্য জাতিকে শাস্তি হিসেবে ভূমিকম্প দিয়েছিলেন।

২. ভূমিকম্প আল্লাহর নিদর্শন ও সতর্কবার্তা

ভূমিকম্প আল্লাহর গজবের পাশাপাশি তা মানুষের তওবা, আত্মসমালোচনা ও আল্লাহর দিকে ফিরে আসার জন্য একটি সতর্কবার্তা হতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন—

وَمَا نُرْسِلُ بِالْآيَاتِ إِلَّا تَخْوِيفًا

‘আমি নিদর্শনসমূহ (প্রাকৃতিক বিপর্যয়) পাঠাই শুধুমাত্র ভয়-সতর্কতা প্রদর্শনের জন্য।’ (সুরা আল-ইসরা: আয়াত ৫৯)

৩. ভূমিকম্প আল্লাহর কুদরতের প্রকাশ

ভূমিকম্পে পৃথিবী কাঁপে— কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছাই তাকে স্থির রাখে। এই সবই মহান আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন। কারণ তিনি—

إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

‘নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছুর ওপর সর্বশক্তিমান।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২০)

৪. ভূমিকম্প কিয়ামতের স্মরণ

কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময় ভূমিকম্প হবে। সে সময়ের অবস্থা কেমন ভয়াবহ হবে তা ওঠে এসেছে কুরআনুল কারিমের বর্ণনায়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন—

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّكُمۡ ۚ اِنَّ زَلۡزَلَۃَ السَّاعَۃِ شَیۡءٌ عَظِیۡمٌ   یَوۡمَ تَرَوۡنَهَا تَذۡهَلُ كُلُّ مُرۡضِعَۃٍ عَمَّاۤ اَرۡضَعَتۡ وَ تَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمۡلٍ حَمۡلَهَا وَ تَرَی النَّاسَ سُكٰرٰی وَ مَا هُمۡ بِسُكٰرٰی وَ لٰكِنَّ عَذَابَ اللّٰهِ شَدِیۡدٌ 

‘নিশ্চয় কিয়ামতের ভূকম্পন একটি ভয়াবহ ব্যাপার। সেদিন তোমরা দেখবে প্রত্যেক স্তন্য দানকারিনী আপন দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভধারিণী তার গর্ভপাত করে ফেলবে, আপনি দেখবেন মানুষকে মাতালের মতো, অথচ তারা মাতাল নয়। তবে আল্লাহর আজাবই কঠিন।’ (সুরা হজ: আয়াত ১-২)

অন্য আয়াতে মহান আল্লাহর শক্তি ও কুদরত উপলব্ধি করা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন—

إِذَا زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَا  وَأَخْرَجَتِ الْأَرْضُ أَثْقَالَهَا  وَقَالَ الْإِنسَانُ مَا لَهَا   یَوۡمَئِذٍ تُحَدِّثُ اَخۡبَارَهَا  بِاَنَّ رَبَّكَ اَوۡحٰی لَهَا  یَوۡمَئِذٍ یَّصۡدُرُ النَّاسُ اَشۡتَاتًا ۬ۙ لِّیُرَوۡا اَعۡمَالَهُمۡ ؕ

‘যখন জমিন প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে। আর জমিন তার বোঝা বের করে দেবে। আর মানুষ বলবে, এর কী হলো? সেদিন জমিন তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। কারণ আপনার রব তাকে নির্দেশ দিয়েছেন। সেদিন মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে বের হয়ে আসবে যাতে দেখানো যায় তাদেরকে তাদের নিজদের কৃতকর্ম।’ (সুরা আজ-জিলজাল: আয়াত ১-৬)

হাদিসের আলোকে ভূমিকম্প

১. পাপকর্ম বেড়ে গেলে ভূমিকম্প হবে সতর্কবার্তা। এটি শাস্তি নয় বরং কিয়ামতের আলামত ও সতর্কবার্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

 لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُقْبَضَ الْعِلْمُ وَتَكْثُرَ الزَّلَازِلُ وَيَتَقَارَبَ الزَّمَانُ وَتَظْهَرَ الْفِتَنُ وَيَكْثُرَ الْهَرْجُ وَهُوَ الْقَتْلُ الْقَتْلُ حَتَّى يَكْثُرَ فِيكُمْ الْمَالُ فَيَفِيضَ

‘ক্বিয়ামাত (কিয়ামত) কায়েম হবে না, যে পর্যন্ত না ইল্ম (জ্ঞান) উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং হারজ বৃদ্ধি পাবে। হারজ খুন-খারাবী। তোমাদের ধন-সম্পদ এত বৃদ্ধি পাবে যে, উপচে পড়বে।’ (বুখারি ১০৩৬)

২. ভূমিকম্প দেখলে কী করা উচিত? হাদিসে এসেছে ভূমকম্পের মুখোমুখি হলে আল্লাহ পাকের স্মরণ, দোয়া ও ইসতেগফারের প্রতি আগ্রহী হওয়া। হাদিসে এসেছে—

 فَافْزَعُوا إِلَى ذِكْرِهِ وََدُعَائِهِ وَاسْتِغْفَارِهِ

‘এ ধরনের কিছু ঘটলে আল্লাহর স্মরণে, দোয়ায় ও ইস্তিগফারে ঝুঁকে পড়ো।’ (তাবারানি)

২৩. গুনাহ ও অন্যায়ের সতর্কবার্তা ভূমিকম্প। হযরত আলি বিন আবি তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মাত যখন পনেরটি বিষয়ে লিপ্ত হবে তখন তাদের ওপর বিপদ-আপদ নেমে আসবে। প্রশ্ন করা হলো হে আল্লাহর রাসুল, তা কি কি? তিনি বললেন—

إِذَا كَانَ الْمَغْنَمُ دُوَلاً وَالأَمَانَةُ مَغْنَمًا وَالزَّكَاةُ مَغْرَمًا وَأَطَاعَ الرَّجُلُ زَوْجَتَهُ وَعَقَّ أُمَّهُ وَبَرَّ صَدِيقَهُ وَجَفَا أَبَاهُ وَارْتَفَعَتِ الأَصْوَاتُ فِي الْمَسَاجِدِ وَكَانَ زَعِيمُ الْقَوْمِ أَرْذَلَهُمْ وَأُكْرِمَ الرَّجُلُ مَخَافَةَ شَرِّهِ وَشُرِبَتِ الْخُمُورُ وَلُبِسَ الْحَرِيرُ وَاتُّخِذَتِ الْقَيْنَاتُ وَالْمَعَازِفُ وَلَعَنَ آخِرُ هَذِهِ الأُمَّةِ أَوَّلَهَا فَلْيَرْتَقِبُوا عِنْدَ ذَلِكَ رِيحًا حَمْرَاءَ أَوْ خَسْفًا وَمَسْخًا

‘যখন গনিমতের সম্পদ ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হবে, আমানাত লুটের সম্পদে পরিণত হবে, জাকাত জরিমানা হিসেবে গণ্য হবে, পুরুষ তার স্ত্রীর আনুগত্য করবে এবং মায়ের অবাধ্য হবে, বন্ধুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে কিন্তু পিতার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে, মসজিদে শোরগোল করা হবে, সবচেয়ে খারাপ চরিত্রের লোক হবে তার সম্প্রদায়ের নেতা, কোন ব্যক্তিকে তার অনিষ্টতার ভয়ে সম্মান করা হবে, মদ পান করা হবে, রেশমি বস্ত্র পরিধান করা হবে, নর্তকী গায়িকাদের প্রতিষ্ঠিত করা হবে, বাদ্যযন্ত্রগুলোর বৃদ্ধি হবে এবং এই উম্মতের শেষ সময়ের লোকেরা তাদের পূর্ব যুগের লোকদের অভিসম্পাত করবে, তখন তোমরা একটি অগ্নিবায়ু অথবা ভূমিধ্বস অথবা চেহারা বিকৃতির আজাবের অপেক্ষা করবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২২১০)

ইসলামের আলোকে ভূমিকম্পের কারণ

১. আল্লাহর পরীক্ষা: ধৈর্য ও ঈমান যাচাই। আল্লাহ বলেন—

وَ لَنَبۡلُوَنَّكُمۡ بِشَیۡءٍ مِّنَ الۡخَوۡفِ وَ الۡجُوۡعِ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَنۡفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ ؕ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیۡنَ

‘আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা ও ক্ষতি দিয়ে এবং প্রাণহানি ও সম্পত্তি এবং ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে পরীক্ষা করব। আর আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন।’ (সুরা বাকারা , আয়াত : ১৫৫)

২. সতর্কবার্তা ও আত্মসমালোচনার সুযোগ: পাপকর্ম থেকে ফিরে আসার জন্য আল্লাহ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

৩. শাস্তি (গজব): অতীতের কিছু জাতি পাপাচারের কারণে শাস্তি পেয়েছে। তবে সব ভূমিকম্পই শাস্তি নয়— এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

৪. আল্লাহর কুদরতের প্রকাশ: মানুষকে বিনয়ী করার জন্য এবং মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে, শেষ কথা আল্লাহরই।

ভূমিকম্পের সময় ও পরে মুসলমানের করণীয়

✔ তওবা করা

✔ বেশি বেশি ইস্তিগফার পড়া

✔ দোয়া করা

✔ সাদকাহ বৃদ্ধি করা

✔ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে দৃঢ় হওয়া

✔ মানুষকে সাহায্য করা

✔ আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা

ভূমিকম্প হোক বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়—এসব আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। কুরআন–হাদিস থেকে আমরা শিখি: ভূমিকম্প কখনো শাস্তি, কখনো পরীক্ষা আবার কখনো সতর্কবার্তা। তবে প্রতিটি ভূমিকম্পকে গজব বলে সিদ্ধান্ত দেওয়া ঠিক নয়—আল্লাহর ব্যাপারে চূড়ান্ত কথা শুধু তিনিই জানেন। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত—এ সব ঘটনা আমাদের হৃদয়কে নরম করে, তওবার পথে ডাকে, আল্লাহর মহাপরাক্রম স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই প্রতিটি কম্পনই আমাদের জীবনের জন্য একটি বড় শিক্ষ— তাই ফিরে আসুনি মহান রবের দিকে। আর স্মরণ করুন কুরআনের এ বাণী—

ءَاَمِنۡتُمۡ مَّنۡ فِی السَّمَآءِ اَنۡ یَّخۡسِفَ بِكُمُ الۡاَرۡضَ فَاِذَا هِیَ تَمُوۡرُ

‘তোমরা কি নিশ্চিত হয়ে গেছো যে, যিনি আসমানে রয়েছেন তিনি তোমাদেরকেসহ এ জমিনকে ধ্বসিয়ে দেবেন না, অতঃপর আকস্মিকভাবে তা থর থর করে কাঁপতে থাকবে?’ (সুরা মুলক: আয়াত

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার