ইসলামে জেনা বা ব্যভিচার মারাত্মক গুনাহ। ইসলামি শরিয়াহ মতে, মানুষের চারটি অঙ্গের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেই বাস্তবে অনেক গুনাহ ও ব্যভিচারের মতো পাপ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখা খুবই সহজ। আর তাতে ঈমানি শক্তিও বৃদ্ধি পাবে। তন্মধ্যে চোখ ও দৃষ্টিশক্তি একটি।
হাদিসে পাকে প্রিয় নবী (সা.) সব সময় উম্মতে মুসলিমাহকে চোখের হক আদায় করার কথা বলতেন। চলাফেরা, ওঠাবসায় চোখ ও দৃষ্টিশক্তি সংযত করার কথা বলতেন। কারণ মানুষের জন্য চোখ ও দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তা রক্ষা করা লজ্জাস্থানকে রক্ষা করার শামিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন-
غُضُّوْا أَبْصَارَكُمْ، وَاحْفَظُوْا فُرُوْجَكُمْ
‘তোমরা তোমাদের চোখকে নিচু করে রাখ এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত কর।’ (মুসনাদে আহমাদ ৫/৩২৩, মুসতাদরাকে হাকেম ৪/৩৫৮-৩৫৯, ইবনে হিব্বান ২৭১, বায়হাকি ৬/২৮৮)
হঠাৎ ঘটনাক্রমে কোনো হারাম বস্তুর উপর চোখ পড়ে গেলে তা তড়িঘড়ি ফিরিয়ে নিতে হবে। চোখ বা দৃষ্টি সরাতে দেরি করা যাবে না। এমনকি দ্বিতীয়বার কিংবা একদৃষ্টে ওদিকে তাকিয়ে থাকাও যাবে না। হাদিসের বর্ণনা থেকে তা প্রমাণিত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার হজরত আলিকে (রা.) উদ্দেশ করে বলেন-
يَا عَلِيُّ! لَا تُتْبِعِ النَّظْرَةَ النَّظْرَةَ، فَإِنَّ لَكَ الْأُوْلَى، وَلَيْسَتْ لَكَ الْآخِرَةُ
‘হে আলি! বার বার দৃষ্টিক্ষেপণ করো না। কারণ হঠাৎ দৃষ্টিতে তোমার কোনো দোষ নেই। তবে ইচ্ছাকৃত দ্বিতীয় দৃষ্টি অবশ্যই দোষের।’ (আবু দাউদ ২১৪৯, তিরমিজি ২৭৭৭, মুসনাদে আহমাদ ৫/৩৫১-৩৫৩-৩৫৭, মুসতাদরাকে হাকেম ২/১৯৪, বায়হাকি ৭/৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) অসংযত (হারাম) দৃষ্টিকে চোখের জেনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমনিভাবে কোনো ব্যক্তির হাত, পা, মুখ, কান, মনও ব্যভিচার করে থাকে। তবে এসবের মধ্যে মারাত্মক হচ্ছে লজ্জাস্থানের ব্যভিচার। যাকে বাস্তবেই ব্যভিচার বলা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন-
إِنَّ اللهَ كَتَبَ عَلَى ابْنِ آدَمَ حَظَّهُ مِنَ الزِّنَا، أَدْرَكَ ذَلِكَ لَا مَحَالَةَ، فَزِنَا الْعَيْنَيْنِ النَّظَرُ، وَزِنَا اللِّسَانِ الْـمَنْطِقُ، وَالْيَدَانِ تَزْنِيَانِ فَزِنَاهُمَا الْبَطْشُ، وَالرِّجْلَانِ تَزْنِيَانِ فَزِنَاهُمَا الْـمَشْيُ، وَالْفَمُ يَزْنِيْ فَزِنَاهُ الْقُبَلُ، وَالْأُذُنُ زِنَاهَا الِاسْتِمَاعُ، وَالنَّفْسُ تَمَنَّى وَتَشْتَهِيْ، وَالْفَرْجُ يُصَدِّقُ ذَلِكَ وَيُكَذِّبُهُ.
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক আদম সন্তানের জন্য জেনার কিছু অংশ বরাদ্দ করে রেখেছেন। যা সে অবশ্যই করবে। (যেমন)- চোখের জেনা হচ্ছে অবৈধভাবে কারোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া। মুখের জেনা হচ্ছে অশ্লীল কথোপকথন করা। হাতও ব্যভিচার করে, তবে তার ব্যভিচার হচ্ছে অবৈধভাবে কাউকে হাত দিয়ে ধরা। পা-ও ব্যভিচার করে, তবে তার ব্যভিচার হচ্ছে কোনো ব্যভিচারের ঘটনায় জড়িত হতে কোথাও পায়ে হেঁটে যাওয়া। মুখও ব্যভিচার করে, তবে তার ব্যভিচার হচ্ছে অবৈধভাবে কাউকে চুমু দেওয়া। কানের ব্যভিচার হচ্ছে অশ্লীল কথা শোনা। মনও ব্যভিচারের কামনা-বাসনা করে। আর তখনই লজ্জাস্থান তা বাস্তবায়ন করে থাকে।’ (আবু দাউদ ২১৫২, ২১৫৩, ২১৫৪)
মনে রাখা জরুরি
দৃষ্টিশক্তির কুফল হচ্ছে- আফসোস, ঊর্ধ্বশ্বাস ও অন্তরজ্বালা। কারণ, মানুষ যা চায় তার সবটুকু সে কখনোই পায় না। আর তখনই তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে।
তাছাড়া চোখ বা দৃষ্টিশক্তিই সব অঘটনের মূল। কারণ, চোখ কোনো কিছু দেখার পরই তা মনে জাগে। মনে জাগলে তার প্রতি চিন্তা আসে। চিন্তা আসলে অন্তরে তাকে পাওয়ার কামনা-বাসনা জন্মে। কামনা-বাসনা জন্মানোর ফলেই তাকে খুব কাছে পাওয়ার ইচ্ছে হয়। দীর্ঘ দিনের ইচ্ছে প্রতিজ্ঞার রূপ ধারণ করে। এ ধারাবাহিক কাজগুলোর মধ্যে যদি কোনো ধরনের বাধা না থাকে, তখনই কোনো কর্ম সংঘটিত হয়।
মানুষের দৃষ্টি যদি খারাপ হয় তবে তা সব সীমাকেই অতিক্রম করে ফেলে। কারণ দৃষ্টি হচ্ছে তীরের মতো। যা মানুষের অন্তরকে নাড়া দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে। দৃষ্টির এ আঘাতের ফলেই মানুষের ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। একবার দৃষ্টি খারাপ হয়ে গেলে তা থেকে ফিরে আসা খুবই কঠিন।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, ব্যভিচারের মতো মারাত্মক অপরাধ থেকে বাঁচতে প্রথমেই নিজেদের চোখ ও দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ করা। যেমনটি হাদিসে এসেছে, চোখের অবাধ দৃষ্টি একে অপরকে জান্নাতে পৌঁছানোর পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, আর দৃষ্টি সংযত রাখা ইসলামের পরিপূর্ণতা এবং সততার লক্ষণ।