বিবাহ ইসলামে এক পবিত্র চুক্তি — মিসাকান গালিজা (অটুট বন্ধন)। কিন্তু কখনো-কখনো জীবনের ঝগড়া, রাগ বা ভুল বোঝাবুঝির মুহূর্তে স্বামী মুখে ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করে ফেলেন। প্রশ্ন জাগে- রাগের মাথায় বলা এই তালাক কি সত্যিই কার্যকর হয়? না কি রাগ থাকলে তালাক হয় না?
দেখা যাক, ইসলাম কী বলে—
শুধু রাগের মাথায় নয় কেউ যদি ঠাট্টাচ্ছলেও স্ত্রীকে বলে ‘তোমাকে তালাক দিলাম’, তাহলেও তা বাস্তব তালাক হিসেবে গণ্য হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
ثَلَاثٌ جِدُّهُنَّ جِدٌّ، وَهَزْلُهُنَّ جِدٌّ: النِّكَاحُ، وَالطَّلَاقُ، وَالرَّجْعَةُ
‘তিনটি বিষয়ে সিরিয়াসভাবে বলা হোক বা ঠাট্টা করে বলা হোক; তা বাস্তব হিসেবে গণ্য হবে- বিয়ে, তালাক, ও তালাক প্রত্যাহার।’ (আবু দাউদ২১৯৪ তিরমিজি ১১৮৪, ইবন মাজাহ ২০৩৯)
যখন স্বামী রাগে উত্তেজিত হলেও নিজের কথা বোঝে এবং ‘তালাক’ শব্দটি ইচ্ছাকৃতভাবে বলে— তখন তালাক কার্যকর হয়ে যায়।
তবে যদি রাগ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে মানুষ বুঝতে পারে না সে কী বলছে, নিজের কাজ বা কথা সম্পর্কে সচেতন থাকে না— তখন তালাক কার্যকর হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
لَا طَلَاقَ وَلَا عِتَاقَ فِي إِغْلَاقٍ
‘চরম রাগ, জবরদস্তি বা মানসিক অচেতন অবস্থায় কোনো তালাক বা দাসমুক্তি কার্যকর নয়।’ (আবু দাউদ ২১৯৩, ইবনে মাজাহ ২০৪৬)
এ হাদিসে ‘إِغْلَاقٍ’ (ইগলাক) শব্দটির অর্থ— এমন মানসিক অবস্থা, যেখানে চিন্তাশক্তি বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ রাগে বলা তালাক কার্যকর হয়, কিন্তু অচেতন বা মানসিক ভারসাম্যহীন রাগে বলা তালাক কার্যকর হয় না।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন-
‘যে ব্যক্তি রাগে নিজের কথা বুঝতে পারে না, তার দেওয়া তালাক গণ্য নয়।’ (ই’লামুল মুওয়াক্কি’ইন ৩/৩৯)
কিন্তু সাধারণ রাগ, যেখানে মানুষ জানে সে কী বলছে, শুধু আবেগে ক্ষুব্ধ— সে অবস্থায় তালাক দিলে তা কার্যকর হবে।
রাগ দুই রকম
> চরম রাগ (অচেতন অবস্থায়): তালাক কার্যকর নয়।
> সাধারণ রাগ (সচেতন অবস্থায়): তালাক কার্যকর হয়, তবে এটি অপছন্দনীয় কাজ।
তালাক শব্দ ও এর প্রকাশের ধরন-
স্বামী যদি বলে, ‘তুমি তালাক’, ‘তোমাকে তালাক দিলাম’ তবে তালাক কার্যকর হয়।
যদি নিয়তের মাধ্যমে তালাক বোঝায় এমন কিছু বলে। যেমন-
> তুমি তোমার বাড়ি চলে যাও
> তুমি আমার জন্য হারাম
> তুমি নতুন স্বামী খোঁজো— তাহলে নিয়ত থাকলে তালাক হিসেবে গণ্য হবে। (ফিকহুল ইসলাম ওয়াদিল্লাতুহু ৭/৩৮২)
কুরআনের দৃষ্টিতে তালাক
তালাক একটি সচেতন, গুরুতর ও আইনি ঘোষণা, যা রাগ বা ঠাট্টায় উচ্চারিত হলেও প্রভাব ফেলে। আল্লাহ তাআলা একাধিক আয়াতে বলেন-
ٱلطَّلَٰقُ مَرَّتَانِۖ فَإِمْسَاكٌۢ بِمَعْرُوفٍ أَوْ تَسْرِيحٌۢ بِإِحْسَٰنٍ
‘তালাক দুইবার; তারপর হয় সুন্দরভাবে সংসার বজায় রাখো, নয়তো সদয়ভাবে বিচ্ছেদ করা।’ (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ২২৯)
তালাকের সীমা ও পুনরাগমন
একবার বা দুবার তালাকের পর স্বামী ইদ্দতের মধ্যে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারে, কিন্তু তৃতীয়বার তালাক দিলে স্ত্রীকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার বা পুনর্মিলনের কোনো সুযোগ থাকে না। আল্লাহ তাআলা বলেন-
فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِنۢ بَعْدُ حَتَّىٰ تَنكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ
‘যদি সে (স্বামী) তাকে আবার তালাক দেয়, তাহলে সে তার জন্য হালাল হবে না যতক্ষণ না অন্য স্বামীর সাথে বিয়ে করে।’ (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ২৩০)
ইসলামে তালাকের অবস্থান
ইসলামে বিবাহ বিচ্ছেদকে তালাক বলে। এটি ইসলামের নিকৃষ্ট বৈধ কাজ। হাদিসেও তালাককে নিকৃষ্ট বৈধ কাজ বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
أَبْغَضُ الْحَلَالِ إِلَى اللَّهِ الطَّلَاقُ
‘আল্লাহর নিকট সবচেয়ে অপছন্দনীয় হালাল বিষয় হলো তালাক।’ (আবু দাউদ ২১৭৮)
তালাক বৈধ হলেও ইসলাম এটিকে অত্যন্ত অপছন্দ করে। কারণ এটি একটি সম্পর্ক, পরিবার, এমনকি সমাজ ভাঙার সূচনা। এক মুহূর্তের রাগে বলা একটি শব্দ ‘তালাক’, ভেঙে দিতে পারে একটি পরিবার, ধ্বংস করতে পারে এক জীবন, যা একসময় ছিল ভালোবাসা ও শান্তির ঘর। তাই ইসলাম শিক্ষা দেয়—
> রাগের সময় চুপ থাকা
> সমস্যায় পরামর্শ নেওয়া
> শেষ উপায় হিসেবেই তালাকের দিকে যাওয়া
এসব বিষয় থেকে সতর্কতা অবলম্বনে আল্লাহর কাছে এ বলে বেশি বেশি প্রার্থনা করা-
اللَّهُمَّ أَلْهِمْنَا الْحِلْمَ وَاحْفَظْ أَلْسِنَتَنَا عِندَ الْغَضَبِ
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা আলহিমনাল হিলমা ওয়াহফিজ আলসিনাতানা ইংদাল গদাব।’
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাদের ধৈর্য ও সংযম দান করুন এবং রাগের সময় আমাদের জবানকে রক্ষা করুন।’