বডি স্প্রে ব্যবহার করা কি জায়েজ, তা ব্যবহারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৭ পিএম
মানুষ সুগন্ধি হিসেবে পারফিউম, সেন্ট বা বডি স্প্রে ব্যবহার করে থাকে। এসব সেন্ট কিংবা বডি স্প্রেতে অ্যালকোহলও থাকে। প্রশ্ন হলো- এসব অ্যালকোহলযুক্ত সুগন্ধি তথা সেন্ট বা বডি স্প্রে ব্যবহার করলে নামাজ পড়া যাবে কি? কিংবা পবিত্রতা রক্ষা হবে কি?
পরিচ্ছন্নতা ও সুগন্ধি— ইসলাম এই দুটি বিষয়কে শুধু ভালো কাজ হিসেবে নয়, বরং ঈমানের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে সম্মানিত করে সৃষ্টি করেছেন আর পরিচ্ছন্নতা সেই সম্মানেরই প্রতিফলন। সুগন্ধি ব্যবহার শুধু আভিজাত্য নয়, এটি পরিচ্ছন্নতা, ইসলামের একটি সুন্নাত ও সুন্দর অভ্যাস।
সুগন্ধি ব্যবহার— নবীজি (সা.)-এর একটি প্রিয় সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (সা.) সুগন্ধি অত্যন্ত পছন্দ করতেন এবং প্রায় সর্বক্ষণই তা ব্যবহার করতেন। তিনি অন্যদেরও এ বিষয়ে উৎসাহ দিতেন। হাদিসে এসেছে—
مَنْ اغْتَسَلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَتَطَهَّرَ بِمَا اسْتَطَاعَ مِنْ طُهْرٍ، ثُمَّ ادَّهَنَ أَوْ مَسَّ مِنْ طِيبٍ، ثُمَّ رَاحَ إِلَى الْمَسْجِدِ فَلَمْ يُفَرِّقْ بَيْنَ اثْنَيْنِ، غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَ الْجُمُعَتَيْنِ.
‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করবে, যতটুকু পারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হবে, তেল বা সুগন্ধি ব্যবহার করবে, এরপর মসজিদে যাবে... তার গত জুমা ও এ জুমার মধ্যবর্তী গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি ৮৮৩)
অন্য হাদিসে এসেছে —
نِعْمَتِ الطِّيبُ الْمِسْكُ
‘সেরা সুগন্ধি হলো মিস্ক।’ (মুসলিম ২২৫২)
সুগন্ধি ব্যবহার শুধু অনুমোদিত নয়, বরং সুন্নাতে মুয়াক্কাদা (নিশ্চিতভাবে প্রিয় সুন্নাত)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জুমার দিন আল্লাহ মুসলমানদের জন্য ঈদের দিন করেছেন। তাই যে জুমার নামাজে আসবে, সে যেন গোসল করে, সুগন্ধি লাগায় এবং মিসওয়াক করে।’ (ইবনে মাজাহ ৮৩)
সেন্ট, বডি স্প্রে ও পারফিউমের বিষয়ে ইসলাম কী বলে
বর্তমান যুগে ব্যবহৃত অধিকাংশ পারফিউম, সেন্ট বা বডি স্প্রেতে অ্যালকোহল থাকে। এ থেকেই প্রশ্ন ওঠে— এগুলো ব্যবহার করলে কি নামাজ পড়া বৈধ? এগুলো কি নাপাক (অশুদ্ধ)?
ইসলামী ফিকহের আলোকে বিশ্লেষণ
কুরআনে মদকে (খামর) নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡخَمۡرُ وَ الۡمَیۡسِرُ وَ الۡاَنۡصَابُ وَ الۡاَزۡلَامُ رِجۡسٌ مِّنۡ عَمَلِ الشَّیۡطٰنِ فَاجۡتَنِبُوۡهُ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ
‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।।’ (সূরা আল-মায়িদাহ: আয়াত ৯০)
কিন্তু এই আয়াতে “রিজস” শব্দটি আত্মিক অপবিত্রতা বোঝায়, শারীরিক নাপাকতা নয়। অর্থাৎ মদ খাওয়া হারাম, কিন্তু স্পর্শ করলে শরীর নাপাক হয় না।
ফকিহদের ব্যাখ্যা
প্রখ্যাত ইসলামি আইনবিদ ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘খামর (মদ) আত্মিকভাবে অপবিত্র, কিন্তু শরীর বা পোশাককে নাপাক করে না।’ (শরহে মুসলিম ৯/১৮৫)
বর্তমানে বাজারে প্রচলিত সেন্ট ও বডি স্প্রেতে সাধারণত যে ধরনের অ্যালকোহল মেশানো হয়, তা অপবিত্র নয়। আধুনিক যুগের প্রখ্যাত ফকিহ শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানি (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘যে অ্যালকোহল এখন বিভিন্ন ঔষধ বা পারফিউমে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তার অধিকাংশই এখন আর আঙ্গুর বা খেজুর থেকে তৈরি হচ্ছে না। বরং বিভিন্ন ধরনের শস্যদানা, খোসা এবং খনিজ পদার্থ ইত্যাদি থেকেই তৈরি করা হচ্ছে। ’ (তাকমিলাতু ফাতহুল মুলহিম ৩/৬০৮)
অতএব, এসব অ্যালকোহল মদ নয় এবং নাপাকও নয়।
বর্তমান পারফিউমের বাস্তব অবস্থা
আজকের বাজারে যে সেন্ট ও বডি স্প্রে পাওয়া যায়, সেগুলোতে ব্যবহৃত অ্যালকোহল সাধারণত ইন্ডাস্ট্রিয়াল বা কেমিক্যাল অ্যালকোহল, যা খাওয়ার উপযোগী নয়, নেশা সৃষ্টিকারী নয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত (denatured alcohol), যা মদ নয়। সুতরাং, এগুলো ব্যবহার নাপাক নয় এবং নামাজের ক্ষেত্রেও বৈধ।
যেখানে সতর্ক থাকতে হবে
যদি কোনো পারফিউমে প্রমাণসহ জানা যায় যে তাতে খামরজাত (মদ্যপানযোগ্য) অ্যালকোহল সরাসরি মিশ্রিত রয়েছে, তাহলে তা ব্যবহার করা অনুচিত ও হারাম হবে। কিন্তু সাধারণ বডি স্প্রে, সেন্ট বা পারফিউম, যেখানে এমন প্রমাণ নেই, তা শরীয়তের দৃষ্টিতে পবিত্র এবং ব্যবহার জায়েজ।
পরিশেষে ইসলাম সৌন্দর্য, পরিচ্ছন্নতা ও সুগন্ধিকে ভালোবাসে। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন এবং তা তাঁর প্রিয়তম জিনিসগুলোর একটি ছিল। তাই বলা যায় —
> সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নাত।
> বাজারে প্রচলিত অ্যালকোহলযুক্ত সেন্ট ও বডি স্প্রে সাধারণত নাপাক নয়।
> এসব ব্যবহার করে নামাজ আদায় করা বৈধ।
> তবে যদি কোনো সেন্টে মদ্যপানযোগ্য অ্যালকোহল মিশ্রিত থাকে, তা বর্জন করা উচিত।