বিয়ের মাধ্যমে একজন নারী পুরুষের জন্য হালাল হয়। এটি পারিবারিক-সামাজিক বন্ধন সৃষ্টির পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তির মাধ্যমে। বিয়ের প্রথম রাতে প্রথমবারের মতো দুটি মন কাছাকাছি আসে। এই সংস্পর্শ দুজনের অন্যরকম অনুভূতি এনে দেয়।
বাসররাতে স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে দু'রাকাত নফল নামাজ পড়ার কোনো নির্দিষ্ট বিধান নেই, তবে সাহাবীদের আমল থেকে এর প্রচলন রয়েছে। অনেক আলেম একে মুস্তাহাব বা উত্তম কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই নামাজ নবদম্পতির জন্য একটি বরকতময় আমল হিসেবে বিবেচিত এবং এটি নবদম্পতিকে আল্লাহর আনুগত্যে একত্রিত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। হাদিসের বর্ণনায় এসেছে-
عَنْ أَبِي وَائِلٍ، قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ مِنْ بَجِيلَةَ إِلَى عَبْدِ اللهِ، فَقَالَ: إِنِّي تَزَوَّجْتُ جَارِيَةً بِكْرًا، وَإِنِّي قَدْ خَشِيتُ أَنْ تَفْرِكَنِي، فَقَالَ عَبْدُ اللهِ: إِنَّ الْإِلْفَ مِنَ اللهِ، وَإِنَّ الْفَرْكَ مِنَ الشَّيْطَانِ، لِيُكَرِّهَ إِلَيْهِ مَا أَحَلَّ اللهُ لَهُ، فَإِذَا دَخَلْتَ عَلَيْهَا فَمُرْهَا فَلْتُصَلِّ خَلْفَكَ رَكْعَتَيْنِ
হযরত আবু ওয়াইল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বজীলাহ গোত্রের এক ব্যক্তি আবদুল্লাহ (রা.)-এর কাছে এসে বলল- আমি একটি কুমারী নারীকে বিবাহ করেছি এবং আমি ভয় পাচ্ছি যে সে আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করবে। তখন আবদুল্লাহ (রা.) বললেন, ‘তোমার মধ্যে স্নেহ (ইলফ) আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর ঘৃণা (ফর্ক) শয়তানের পক্ষ থেকে। শয়তান তাকে আল্লাহর হালালকৃত জিনিস থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে। যখন তুমি তার কাছে প্রবেশ করবে, তখন তাকে বলো যে, সে যেন তোমার পেছনে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে।’ (তাবারানি ৮৯৯৩; মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক ১০৪৬১)
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ مَوْلَى بَنِي أُسَيْدٍ قَالَ: تَزَوَّجْتُ امْرَأَةً، وَأَنَا مَمْلُوكٌ، فَدَعَوْتُ أَصْحَابَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فِيهِمْ أَبُو ذَرٍّ، وَابْنُ مَسْعُودٍ، وَحُذَيْفَةُ، فَتَقَدَّمَ حُذَيْفَةُ لِيُصَلِّيَ بِهِمْ، فَقَالَ أَبُو ذَرٍّ، أَوْ رَجُلٌ: لَيْسَ لَكَ ذَلِكَ، فَقَدَّمُونِي، وَأَنَا مَمْلُوكٌ، فَأَمَمْتُهُمْ فَعَلَّمُونِي قَالُوا: «إِذَا أُدْخِلَ عَلَيْكَ أَهْلُكَ فَصَلِّ رَكْعَتَيْنِ، وَمُرْهَا فَلْتُصَلِّ خَلْفَكَ، وَخُذْ بِنَاصِيتِهَا، وَسَلِ اللَّهَ خَيْرًا، وَتَعَوَّذْ بِاللَّهِ مِنْ شَرِّهَ
হযরত আবু সাঈদ মাওলা বানী উসায়িদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি একটি নারীকে বিবাহ করেছিলাম, এবং আমি ছিলাম একজন দাস (মমলুক)। তখন আমি নবী (সা.)-এর সাহাবীদের, তাদের মধ্যে আবু ধর, ইবনে মাসউদ এবং হুযায়ফাহ (রা.) কে আমন্ত্রণ জানালাম। হুযায়ফাহ (রা.) আমাদের মধ্যে প্রথমে নামাজ পড়ানোর জন্য এগিয়ে আসলেন, কিন্তু আবু ধর বা একজন সাহাবী বললেন, ‘তুমি নামাজে ইমাম হতে পার না, কারণ তুমি মমলুক’। এরপর তারা আমাকে (ইমাম হিসেবে) সামনে রেখেছিলেন এবং আমি তাদের ইমামতি করলাম। তারপর তারা আমাকে কিছু শিক্ষা দিলেন। তারা বললেন, ‘যখন তোমার স্ত্রীর সাথে তোমার মিলন হবে, তখন দুই রাকাআত নফল নামাজ পড়ো এবং তাকে বলো, যেন সে তোমার পেছনে নামাজ পড়ে। তার শিরের চুল ধরে তাকে আল্লাহর কাছে মঙ্গল কামনা করো এবং তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও।’ (মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক ১০৪৬২, মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা ১৭১৫৩)
নামাজ পড়ার বিধান
আবশ্যক নয়: বাসর রাতে এই নামাজ পড়া আবশ্যক বা ওয়াজিব নয়।
উত্তম ও মুস্তাহাব: এটি একটি মুস্তাহাব বা উত্তম আমল হিসেবে গণ্য এবং এটি পড়া ভালো বলে বিবেচিত।
জামায়াতে আদায়: বর এতে ইমামতি করবেন এবং স্ত্রী তার পেছনে জামায়াতে নামাজ আদায় করবেন, যা তাদের প্রথম রাত থেকেই আল্লাহর আনুগত্যে একত্রিত হওয়ার একটি প্রতীক।
সাহাবিদের আমল: রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে সরাসরি কোনো সহীহ হাদিস না থাকলেও, কিছু সাহাবির এমন নামাজ আদায়ের বর্ণনা পাওয়া যায়।
নামাজ পড়ার উদ্দেশ্য
বরকতের জন্য: এই নামাজ বরকতের জন্য এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার একটি উত্তম উপায়।
আল্লাহর প্রতি আনুগত্য: এটি নবদম্পতির আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং তাদের বৈবাহিক জীবনের শুরুতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি প্রচেষ্টা।
স্বামী-স্ত্রীর প্রথম সাক্ষাতে আমল
তবে বিয়ের পর প্রথম সাক্ষাতে স্বামী-স্ত্রীর জন্য উত্তম আমল হলো- একে অপরের জন্য দোয়া করা। স্বামী তার স্ত্রীর কপালে হাত রেখে দোয়া করার ব্যাপারে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা.) বর্ণনায় হাদিসের নির্দেশনা রয়েছে। তাহলো-
اَللّهُمَّ بَارِكْ لِىْ فِىْ أَهْلِىْ وَبَارِكْ لَهُمْ فِىَّ، اَللّهُمَّ اجْمَعْ بَيْنَنَا مَا جَمَعْتَ بِخَيْرٍ و فَرِّقْ بَيْنَنَا إِذَا فَرَّقْتَ إِلَى خَيْرٍ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা বারিক লি ফি আহলি ওয়া বারিক লাহুম ফিইয়্যা, আল্লাহুম্মাঝ্মা বাইনানা মা জামা’তা বিখাইরিন ওয়া ফাররিক্ব বাইনানা ইজা ফাররাক্বতা ইলা খাইরিন। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক)
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমার জন্য আমার পরিবারে বরকত দান কর এবং তাদের স্বার্থে আমার মাঝে বরকত দাও। হে আল্লাহ! তুমি যা ভালো একত্রিত করেছ তা আমাদের মাঝে একত্রিত কর। আর যখন কল্যাণের দিকে বিচ্ছেদ কর তখন আমাদের মাঝে বিচ্ছেদ কর।'
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো নারীকে বিয়ে করবে, সে যেন তার কপাল ধরে এবং আল্লাহ তাআলার নাম পড়ে এবং বরকতের দোয়া করে। আর সে যেন বলে-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَهَا، وَخَيْرَ مَا جَبَلْتَهَا عَلَيْهِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا، وَشَرِّ مَا جَبَلْتَهَا عَلَيْهِ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন খাইরিহা ওয়া খাইরিমা ঝাবালতাহা আ’লাইহি; ওয়া আউজুবিকা মিন সাররিহা ওয়া সাররিমা ঝাবালতাহা আলাইহি।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে তার কল্যাণ ও যে কল্যাণের ওপর তাকে সৃষ্টি করেছেন, তা প্রার্থনা করছি। আর তার অমঙ্গল ও যে অমঙ্গলের ওপর তাকে সৃষ্টি করেছেন -তা থেকে আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
স্বামী-স্ত্রীর প্রথম সাক্ষাতে করণীয়
মুমিন মুসলমানের বিয়ের পর প্রথম সাক্ষাতে স্বামী-স্ত্রীর বেশকিছু করণীয় রয়েছে, যা পালন করা খুবই জরুরি। এতে রয়েছে বরকত ও কল্যাণ। তাহলো-
> পরস্পরের জন্য দোয়া করা।
> দোয়ার পর একে অপরকে দুধ বা মিষ্টি জাতীয় খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা।
> পরস্পর ভালোবাসা ও হৃদ্যতাপূর্ণ কথাবার্তা বিনিময় করা।
> পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হওয়া।
> মনের অসংকোচ, ভয়ভীতি, হতাশা ও বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে খোশ গল্প করা।
> আন্তরিকতা ও ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশ কিছু সময় অতিবাহিত করা।
সুতরাং বিয়ের পর প্রথম সাক্ষাতে কিংবা বাসর রাতে নামাজ পড়তেই হবে, না পড়লে গুনাহ হবে বা বিয়ে হবে না; বিষয়টি এমন নয়। তবে নামাজ পড়া উত্তম এবং মোস্তাহাব আমল।