ইসলামের মূল ভিত্তি হলো ঈমান, যা মুসলমানের বিশ্বাসের শক্তি। ঈমান মানুষের অন্তরে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস এবং নবী মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি আস্থার নাম।
ঈমান ছাড়া মুসলিমের জীবন পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না, কারণ ঈমানই তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। একজন মুসলমানের অন্তরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তার জীবনকে বদলে দেয়। এ সম্পর্কে রয়েছে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা।
ঈমান কী?
ঈমান আরবি শব্দ, যা মূলত ‘বিশ্বাস’ বা ‘বিশ্বাসের শক্তি’ বোঝায়। ঈমান অন্তর থেকে আসা বিশ্বাস, যা কেবল মন ও হৃদয়ে থাকবে না, বরং মানুষের সব কাজ, কথাবার্তা এবং আচরণে প্রতিফলিত হবে। ঈমানের ৬টি মৌলিক অংশ রয়েছে-
১. আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস
আল্লাহ এক, তার কোনো শরিক নেই এবং তিনি সৃষ্টি জগতের সবকিছুর মালিক ও পালনকর্তা।
২. ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস
আল্লাহ যে ফেরেশতাদের সৃষ্টি করেছেন, তাদের প্রতি বিশ্বাস রাখা, যারা আল্লাহর আদেশ পালন করেন।
৩. কিতাবের প্রতি বিশ্বাস
আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত কিতাব ও সহিফার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। যেমন- কোরআন, তাওরাত, ইঞ্জিল ও যবূর—এগুলোর প্রতি বিশ্বাস রাখা।
৪. নবী-রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস
আল্লাহ যাদের নবী ও রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন, তাদের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখা। যাদের মধ্যে প্রথম নবী হলেন হজরত আদম (আ.) আর শেষ নবী হলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
৫. আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস
পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখাও ঈমান। যেখানে সৎকর্মের জন্য মানুষকে পুরস্কৃত করা হবে এবং অসৎকর্মের জন্য শাস্তি প্রদান করা হবে।
৬. কদরের প্রতি বিশ্বাস
আল্লাহর সমস্ত সিদ্ধান্ত ও নিয়তি মেনে নেওয়া এবং এ বিশ্বাস করা যে- জীবনের সব কিছু আল্লাহর হাতে।
ঈমান একজন মুসলিমকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করে এবং তাকে একটি সঠিক জীবনের পথে নিয়ে যায়। যারা ঈমান আনয়ন করে, তাদের জীবনে শান্তি, নিরাপত্তা এবং আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা আসে। এ কারণে ঈমানদার ব্যক্তি জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতেও আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে শান্ত থাকতে পারে। পাশাপাশি ঈমান বা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস, একজন মুসলিমের জীবনকে গভীরভাবে বদলে দিতে পারে। ঈমান মানুষের মনোভাব, আচরণ, সম্পর্ক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও পরিবর্তন করতে পারে। তাহলো-
১. আধ্যাত্মিক শান্তি ও স্থিরতা
ঈমান একজন মানুষের অন্তরে গভীর শান্তি এনে দেয়। যখন একজন মুসলিম বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকর্তা এবং সব কিছু তাঁর নিয়ন্ত্রণে, তখন সে জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলোতেও শান্তি ও স্থিরতা অনুভব করে থাকে। এই ঈমানের ফলে একজন মুসলিম জানে যে, তার দুঃখ-কষ্ট আল্লাহ জানেন এবং তিনি তাদের উপযুক্ত পরিণতি প্রদান করবেন। আল্লাহ বলেন-
اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَطۡمَئِنُّ قُلُوۡبُهُمۡ بِذِكۡرِ اللّٰهِ ؕ اَلَا بِذِكۡرِ اللّٰهِ تَطۡمَئِنُّ الۡقُلُوۡبُ
‘যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়; জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়’। (সুরা রাদ: আয়াত ২৮)
২. সৎ কাজ ও নৈতিক উন্নতি
ঈমান একজন মুসলিমকে সৎ, ন্যায়পরায়ণ এবং দায়িত্বশীল বানাতে সাহায্য করে। কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন মুসলিম তার জীবনে সৎ কাজ করার চেষ্টা করে, কারণ সে জানে যে, এই কাজগুলোই তাকে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। ঈমান একজনকে মিথ্যা, চুরি, প্রতারণা, আত্মসর্বস্বতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সতর্ক করে এবং তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। ঈমান একজন মুসলিমকে মনে করিয়ে দেয় যে তার প্রতিটি কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য হতে হবে। ফলে সে তার কর্মকাণ্ডে সততা, সহানুভূতি এবং ন্যায্যতা বজায় রাখে। হাদিসে পাকে নবী (সা.) বলেছেন-
إِنَّمَا ٱلۡأَعْمَالُ بِٱلنِّيَّاتِ
‘কাজ (এর প্রাপ্য হবে) নিয়ত অনুযায়ী।’ (বুখারি ০১)
৩. আল্লাহর প্রতি আস্থা ও নির্ভরশীলতা
ঈমান একটি দৃঢ় আস্থা তৈরি করে। একজন মুসলিম যখন ঈমানের মাধ্যমে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তার উপকারে থাকবেন, তখন সে কোনো পরীক্ষায় পড়লেও তার মনোবল দৃঢ় থাকে। ঈমান তাকে শেখায় যে, আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং তিনি সর্বদা তাঁর বান্দার জন্য ভালো কিছু নিয়ে আসবেন। ঈমানের ফলে, একজন মুসলিম জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলা করার শক্তি পায় এবং যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতেও আল্লাহর সাহায্য পেয়ে থাকে। কোরআনে এসেছে-
وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَهُ مَخْرَجًا"
‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন।’ (সুরা ত্বলাক: আয়াত ২)
৪. সামাজিক সম্পর্কের উন্নতি
ঈমান সমাজে ন্যায়, দয়া এবং সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। যেহেতু ঈমান মানুষের মনে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস সৃষ্টি করে, তাই একজন মুসলিম সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব এবং অন্যদের জন্য সহানুভূতি অনুভব করে। ঈমান মানুষের মনে শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, সহিষ্ণুতা এবং দয়া বৃদ্ধি করে, যার ফলে মানুষের মধ্যে সম্পর্কের দৃঢ়তা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত হয়।
আল্লাহ বলেন- ‘আর মানুষের সাথে ভালো কথা বলো।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ৮৩)
৫. পরকালীন মুক্তির দিশা
ঈমান একজন মুসলিমকে পরকালের জন্য প্রস্তুত করে। এই পৃথিবীতে যা কিছু ঘটছে, তার সবই আল্লাহর ইচ্ছার অধীনে এবং ঈমানী জীবন মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যে, তার সব কিছু পরকালে প্রতিফলিত হবে। এজন্য ঈমান মানুষকে সৎভাবে জীবনযাপন করতে এবং অন্যায় থেকে দূরে থাকতে উৎসাহিত করে, কারণ সে জানে যে, একদিন তাকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। কোরআনে বলা হয়েছে-
وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اُولٰٓئِكَ اَصۡحٰبُ الۡجَنَّۃِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ
‘আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, তারা জান্নাতের অধিবাসী। তারা সেখানে হবে স্থায়ী। ’ (সুরা বাকারা: আয়াত ৮২)
৬. আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা:
ঈমান একজন মুসলিমকে আত্মবিশ্বাসী এবং মর্যাদাপূর্ণ হতে সহায়তা করে। তার ঈমান তাকে শেখায় যে, তার মর্যাদা আল্লাহর কাছে এবং সৎ কর্মের মাধ্যমে সে সর্বদা সঠিক পথেই আছে। এমনকি যখন পৃথিবী তাকে ভুল বুঝতে পারে, তখনও সে জানে তার আত্মমর্যাদা আল্লাহর দৃষ্টিতে অটুট। নবী (সা.) বলেছেন-
لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّىٰ يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ
‘তোমাদের কেউ ঈমানদার হতে পারে না যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্যও তা ভালোবাসে যা নিজের জন্য ভালোবাসে।’ (বুখারী ১৩, মুসলিম ৪৫)
এভাবেই ঈমান ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করে এবং তাদের আচরণ ও মনোভাব পরিবর্তন করে, তাদের একজন ভালো মানুষ এবং সঠিক পথে চলার পথে সাহায্য করে।
ঈমান মানুষের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে—এটি শুধু আধ্যাত্মিক শক্তি নয় বরং মানুষের দৈনন্দিন জীবন এবং সিদ্ধান্তেও প্রতিফলিত হয়।
ঈমান জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক পথ অনুসরণ করতে সহায়তা করে এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক উন্নত করে, যা মানবজীবনে শান্তি, সচ্ছলতা এবং সামাজিক উন্নতি আনে।