পুরুষদের জন্য স্বর্ণ ব্যবহারে বিষয়ে ইসলাম কী বলে?
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০১:২০ পিএম
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বর্ণের আংটি পরা পুরুষদের জন্য নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) হাদিসে স্পষ্টভাবে পুরুষদের জন্য স্বর্ণের গহনাসমূহ পরা নিষেধ করেছেন। তবে নারীদের জন্য স্বর্ণের গহনা পরা ইসলামে অনুমোদিত, কারণ তাদের জন্য এটি সৌন্দর্য ও শোভার অংশ হিসেবে বিবেচিত।
কুরআনের নির্দেশনা ও ব্যাখ্যা
যদিও কুরআনে সরাসরি পুরুষদের স্বর্ণ পরায় নিষেধাজ্ঞা নেই, তবে এতে সাজসজ্জার সীমা ও শালীনতার নীতি সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
قُلۡ مَنۡ حَرَّمَ زِیۡنَۃَ اللّٰهِ الَّتِیۡۤ اَخۡرَجَ لِعِبَادِهٖ وَ الطَّیِّبٰتِ مِنَ الرِّزۡقِ ؕ
‘বল, যে সব সৌন্দর্য-শোভামন্ডিত বস্তু ও পবিত্র জীবিকা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন কে তা হারাম করল’? (সুরা আ‘রাফ: আয়াত ৩২)
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘সাজসজ্জা বা সৌন্দর্যোপকরণ বৈধ, তবে তা এমনভাবে হতে হবে যাতে শরিয়তের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম না করে। পুরুষদের জন্য স্বর্ণ ও রেশম সেই সীমা অতিক্রমের অন্তর্ভুক্ত।’
হাদিসের আলোকে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা
কুরআনে সরাসরি স্বর্ণের গহনাসমূহ নিষিদ্ধ করা হয়নি, তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর হাদিসের মাধ্যমে স্বর্ণের গহনা পরার বিষয়ে একাধিক সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। তাহলো-
হযরত মুআবিয়া ইবনু সুওয়াদ ইবনু মুকাররিন (রহ.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বারা ইবনু আযিব (রা.) এর কাছে গিয়েছিলাম। তখন আমি তাকে বলতে শুনেছি যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের সাতটি জিনিস থেকে নিষেধ করেছেন-
وَنَهَانَا عَنْ خَوَاتِيمَ أَوْ عَنْ تَخَتُّمٍ بِالذَّهَبِ وَعَنْ شُرْبٍ بِالْفِضَّةِ وَعَنِ الْمَيَاثِرِ وَعَنِ الْقَسِّيِّ وَعَنْ لُبْسِ الْحَرِيرِ وَالإِسْتَبْرَقِ وَالدِّيبَاجِ
স্বর্ণের আংটি ব্যবহার করা, রৌপ্য পাত্রে পান করা, মায়াসির (এক জাতীয় নরম রেশমী কাপড়) ও কাসসী (রেশম মিশ্রিত এক জাতীয় মিসরীয় কাপড়) ব্যবহার করা এবং মিহি রেশমী কাপড়, মোটা রেশমী বস্ত্র ও দীবা (খাঁটি রেশমী কাপড়) পরতে নিষেধ করেছেন। (মুসলিম ৫২১৫ ইফা)
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন আল্লাহর রাসুল (সা.) এক ব্যক্তির হাতে স্বর্ণের আংটি দেখলেন। তিনি তার হাত থেকে তা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং বললেন, ‘তোমাদের কেউ কি ইচ্ছাকৃত দোজখের আঙ্গারকে হাতে নিয়ে ব্যবহার করে?’ অতঃপর নবী (সা.) চলে গেলে লোকটিকে বলা হলো- ‘তোমার আংটিটা কুড়িয়ে নিয়ে অন্য কাজে লাগাও। (অথবা তা বিক্রয় করে মূল্যটা কাজে লাগাও।) কিন্তু লোকটি বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমি আর কখনো তা গ্রহণ করব না, যা আল্লাহর রাসুল (স.) ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন।’ (মুসলিম ২০৯০)
হাদিসে আরও এসেছে-
نَهَانَا عَنْ خَاتَمِ الذَّهَبِ أَوْ حَلْقَةِ الذَّهَبِ
‘আমাদেরকে স্বর্ণের আংটি বা সোনার বৃত্ত (রিং) ব্যবহার করতে তিনি নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম ৫২১৮ ইফা)
এমনকি ছোট ছেলে সন্তানকে স্বর্ণ ব্যবহার করতে দেওয়াও বৈধ নয়। এতে তার অভিভাবকের গুনাহ হবে। কেননা হাদিসে এসেছে, হযরত আলী (রা.) বলেন-
إن نَبِي اللهِ صَلَى الله عَلَيهَ وَسَلم أَخَذَ حَرِيراً فَجَعَلَه فِي يَمِينِه، وَأَخَذَ ذَهَباً فَجَعَلَه فِي شِمَالِه، ثم قَالَ: إنَ هذَينِ حَرَامٌ عَلى ذُكُورِ أُمَتي.
নবী কারীম (সা.) তার ডান হাতে রেশমি কাপড় আর বাম হাতে স্বর্ণ নিয়ে বললেন, এই দুটি আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম।’ (আবু দাউদ ৪০৫৪; নাসাঈ ৮/১৬০)
সুতরাং পুরুষের জন্য স্বর্ণের চেন, ঘড়ি, আংটি, বোতাম, কলম ইত্যাদি ব্যবহার বৈধ নয়। যেহেতু নবী (সা.) বলেন-
أُحِلَّ الذَّهَبُ وَالْحَرِيرُ لِلْإِنَاثِ مِنْ أُمَّتِي وَحُرِّمَ عَلَى ذُكُورِهَا
‘স্বর্ণ ও রেশম আমার উম্মতের মহিলাদের জন্য হালাল এবং পুরুষদের জন্য হারাম করা হয়েছে।’ (মিশকাত ৪৩৪১)
ইসলামের দৃষ্টিকোন থেকে সুস্পষ্ট যে, পুরুষদের জন্য স্বর্ণ ব্যবহার শরীয়তসম্মত নয়, বরং এটি জাহান্নামের আগুনের প্রতীক হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।
ফিকহি মতামত
> চারটি প্রধান মাজহাব—হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি—সব মাজহাবের আলেমগণ একমত যে, পুরুষদের জন্য স্বর্ণ পরা বৈধ নয়।
> ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন: ‘পুরুষের জন্য স্বর্ণ বা রেশমের কোনো অংশ বৈধ নয়, যদি না যুদ্ধ বা চিকিৎসায় প্রয়োজন পড়ে।’
> ইমাম নববী (রহ.) বলেন: ‘এই নিষেধাজ্ঞা এমন মাত্রায় প্রযোজ্য যে, স্বর্ণের সামান্য অংশও পরা জায়েয নয়।’ (শারহ মুসলিম, খণ্ড ১৪, পৃ. ৩২)
> ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘পুরুষের জন্য স্বর্ণ হারাম করা হয়েছে, যাতে নারী-পুরুষের বাহ্যিক রূপে পার্থক্য বজায় থাকে এবং পুরুষ অহংকার, বিলাসিতা ও আত্মম্ভরিতার পথে না যায়।’ (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, খণ্ড ২, পৃ. ৩১২)
> ইবনে কাইয়িম জাওযি (রহ.) বলেন, ‘স্বর্ণের প্রতি আসক্তি আত্মতৃপ্তি ও অহংকারের প্রতীক, যা পুরুষের বিনয় ও আধ্যাত্মিক চরিত্রকে দুর্বল করে।’ (ইলামুল মুওয়াক্কি‘ইন, খণ্ড ১, পৃ. ৪৮৬)
> আধুনিক ইসলামি চিন্তাবিদদের মধ্যে ইউসুফ কারজাভি বলেন, ‘স্বর্ণ পুরুষের জন্য মানানসই নয়; এটি পার্থিব সৌন্দর্যের প্রতীক, আর ইসলাম পুরুষকে আত্মিক সৌন্দর্যের দিকে আহ্বান করে।’ (আল-হালাল ওয়াল-হারাম ফিল ইসলাম, পৃ. ৭৩)
প্রকৃতপক্ষে স্বর্ণ নিষিদ্ধকরণ পুরুষের আত্মসংযম, বিনয় ও মানসিক শক্তি রক্ষার এক মাধ্যম। তা ছাড়া স্বর্ণ সাধারণত সৌন্দর্য, বিলাসিতা ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। ইসলাম চায় না পুরুষ বাহ্যিক অলঙ্কারে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করুক; বরং তার মর্যাদা নির্ধারিত হোক চরিত্র, জ্ঞান ও দায়িত্ববোধে।