সুনামি কী? ভূমিকম্পের পরই কি সবসময় সুনামির সতর্কতা জারি হয়?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৩৩ এএম
শান্ত সমুদ্র হঠাৎই রুদ্রমূর্তি ধারণ করল। নীল জলের বুকের গভীরে জন্ম নিলো অশনিসংকেত। আজ (৮ ডিসেম্বর) শক্তিশালী ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল জাপানের উপকূলীয় অঞ্চল। এই ভূকম্পন এতটাই ভয়ংকর ছিল যে, মুহূর্তের মধ্যেই জারি করা হয়েছে জরুরি সতর্কতা–উপকূলে যে কোনো সময় আছড়ে পড়তে পারে ১০ ফুট (৩ মিটার) উচ্চতার বিধ্বংসী সুনামি। উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে এখন শুধুই সাইরেনের শব্দ আর নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটতে থাকা মানুষের ভিড়।
স্থানীয় সময় রাত সোয়া ১১টায় জাপানের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে ৭.৬ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের ৩৩ মাইল গভীরে। কম্পনের কেন্দ্র ছিল সমুদ্রের তলদেশে। ভূমিকম্পের পরপরই জাপানের আবহাওয়া সংস্থা (জেএমএ) তাৎক্ষণিকভাবে ১০ ফুট উচ্চতার সুনামি আঘাত হানতে পারে–এমন আশঙ্কায় উপকূলজুড়ে জরুরি সতর্কতা জারি করে। বহু এলাকায় মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে, এবং লোকজনকে উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখনও কোনো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের খবর না এলেও, পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
জাপানের এই ঘটনায় অনেকের মনেই স্বাভাবিকভাবেই কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন উসকে দিয়েছে: সুনামি আসলে কী? ভূমিকম্পের পরই কি সবসময় সুনামির সতর্কতা জারি হয়? এবং কখন বা কী কারণে সুনামি সৃষ্টি হয়? বিশেষজ্ঞদের মতামত ও বৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্লেষণ করে এর উত্তরগুলো তুলে ধরা হলো:
সুনামি কী?
সুনামি (Tsunami) শব্দটি এসেছে জাপানি ভাষা থেকে, যার অর্থ ‘পোতাশ্রয়ের ঢেউ’ (Tsu = পোতাশ্রয়, Nami = ঢেউ)। এটি হলো সমুদ্রের তলদেশে বিশাল পরিমাণে জলরাশি হঠাৎ করে স্থানচ্যুত হওয়ার ফলে সৃষ্ট অত্যধিক দীর্ঘ তরঙ্গমালা।
ভ্রান্ত ধারণা: সুনামির ঢেউ সাধারণ জোয়ারের ঢেউয়ের মতো নয়। সুনামি আসলে এক দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ঢেউ, যা গভীর সমুদ্রে খুব দ্রুত (ঘণ্টায় প্রায় ৫০০ থেকে ১০০০ কিলোমিটার) গতিতে ছুটতে পারে।
বিপজ্জনক রূপ: গভীর সমুদ্রে সুনামির ঢেউয়ের উচ্চতা কম থাকলেও, উপকূলের অগভীর জলে আসার সময় এর গতি কমে যায় এবং শক্তি সঞ্চয় করে এর উচ্চতা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় (কখনও কখনও ১০০ ফুট বা ৩০ মিটারের বেশি)।
ভূমিকম্পের পরই কি সুনামির সতর্কতা আসে?
না, সবসময় নয়। সব ভূমিকম্পই সুনামি সৃষ্টি করে না। সুনামির সতর্কতা বা ঝুঁকি মূলত দুটি প্রধান বিষয়ের ওপর নির্ভর করে:
ভূমিকম্পের মাত্রা: সাধারণত, রিখটার স্কেলে ৬.৫ বা তার বেশি মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প সুনামি সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট হতে পারে।
ভূমিকম্পের অবস্থান ও প্রকৃতি: সুনামির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হলো ‘সাবডাকশন জোন’-এ (যেখানে একটি টেকটোনিক প্লেট অন্যটির নিচে প্রবেশ করে) সংঘটিত হওয়া ভূমিকম্প। ভূমিকম্পটি সমুদ্রের তলদেশে হতে হবে এবং এর ফলে সমুদ্রতল উল্লম্বভাবে স্থানচ্যুত হতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ: শুধু আনুভূমিক (পাশাপাশি) স্থানচ্যুতি সুনামি সৃষ্টিতে খুব একটা কার্যকর নয়। উল্লম্ব স্থানচ্যুতির ফলে জলরাশি স্থানান্তরিত হয়ে সুনামি তরঙ্গ তৈরি করে।
তাই শক্তিশালী সামুদ্রিক ভূমিকম্প হলেই সতর্কতার অংশ হিসেবে দ্রুত সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়।
কখন বা কী কারণে সুনামি হয়?
সুনামি সৃষ্টির প্রধান কারণগুলো হলো:
বিশাল আকারের সমুদ্রতলীয় ভূমিকম্প: এটিই সুনামির সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রধান কারণ। উল্লম্ব স্থানচ্যুতির ফলে সমুদ্রের তলদেশ উপরে বা নিচে সরে যায়, যা বিপুল পরিমাণ জলরাশিকে ঠেলে দেয়।
সমুদ্রগর্ভে ভূমিধস: শক্তিশালী ভূমিকম্প বা অন্য কোনো কারণে সমুদ্রের তলদেশের মাটি বা পলি হঠাৎ ধসে পড়লে তা জলকে স্থানচ্যুত করে সুনামি তৈরি করতে পারে।
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত: সমুদ্রের নিচে বা উপকূলে অবস্থিত কোনো আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ বা ধস বিপুল পরিমাণ জলরাশিকে উৎক্ষিপ্ত করে সুনামি ঘটাতে পারে।
উল্কাপাত: যদিও বিরল, সমুদ্রের মধ্যে বিশাল কোনো উল্কাপিণ্ড বা গ্রহাণুর পতন বিশাল তরঙ্গমালা সৃষ্টি করতে পারে।
এরমধ্যে ভূমিকম্পই সবচেয়ে বেশি সুনামির জন্ম দেয়। বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরের ‘রিং অব ফায়ার’ অঞ্চলে–যেখানে জাপান অবস্থিত–সুনামির ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি।
জাপানের বর্তমান সতর্কতা জারি হওয়ার কারণ হলো, শক্তিশালী কম্পনটি সমুদ্রের তলদেশে ঘটেছিল এবং এর প্রকৃতি উল্লম্ব স্থানচ্যুতির নির্দেশ করছে। উপকূলের কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষদের দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বলা হয়েছে।