ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি মার্কিন অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৫৬ এএম
অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখলেও রাজনেতিক কারণে তাদের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের খড়গ নেমে এসেছে। অভিবাসন খাত বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রম ঘাটতিও পূরণ করে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র বিদেশি নাগরিক আশ্রয় ব্যবস্থাপনা সংস্কার ও সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে গিয়ে অভিবাসীদের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। অভিবাসন খাত মার্কিন অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখলেও অভিবাসীরা রাজনৈতিক বিভাজনের শিকার। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক থিংক ট্যাংক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
২০২৫ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগের অভিবাসন নীতিতে অনেক পরিবর্তন এনেছেন। তিনি একইসঙ্গে বৈধ ও অননুমোদিত উভয় অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি নিয়েছেন। এই অবস্থায় মার্কিন শ্রমবাজারে অভিবাসীদের অর্থনৈতিক ভূমিকা নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
আমেরিকান ইমিগ্রেশন কাউন্সিলের জরিপ অনুসারে, ২০২৩ সালে প্রায় ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অবদান ছিল অভিবাসীদের। ওই বছর তারা স্থানীয়, রাজ্য ও ফেডারেল কর হিসেবে প্রায় ৬৫২ বিলিয়ন ডলার প্রদান করে। অনথিভুক্ত অভিবাসীরাও মার্কিন অর্থনীতিতে অবদান রাখেন। ২০২৩ সালে অ-নথিভুক্ত অভিবাসীদের ব্যয় সক্ষমতা ছিল ২৯৯ বিলিয়ন ডলার। তাদের সম্মিলিত আয় ছিল প্রায় ৩৮৯ বিলিয়ন ডলার। যা থেকে তারা ৯০ বিলিয়ন ডলার কর পরিশোধ করেন।
তবুও অভিবাসনে বিধিনিষেধ সমর্থনকারীদের যুক্তি, অ-নথিভুক্ত অভিবাসীরা অর্থপাচার করে থাকে; যা রাজ্য ও স্থানীয় বাজেটের ওপর এর প্রভাব পড়ে। তাছাড়া বিরাট সংখ্যক অভিবাসীর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় বড় অংকের ব্যয় করতে হয় মার্কিন সরকারকে।
তবে বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, অভিবাসীরা মার্কিন অর্থনীতির জন্য ভাল। কারণ তাদের কারণে শ্রমশক্তির আকার বাড়ে। তারা কর রাজস্ব ও ভোক্তা চাহিদা বৃদ্ধিতেও সহায়ক। তবে মজুরির ওপর অভিবাসনের প্রভাব নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জর্জ বোর্জাসের মতো কিছু গবেষক স্বল্পদক্ষ শ্রমশক্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে অর্থনীতিবিদ জিওভানি পেরির মতো বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী কর্মীর মজুরির ওপর খুব কম প্রভাব ফেলে।
যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা
শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিএলএস) অনুসারে, ২০২৪ সালেও প্রায় ৩১ মিলিয়ন অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে কর্মে যুক্ত ছিলেন। এই সংখ্যা দেশটির মোট বেসামরিক কর্মী বাহিনীর ১৯.২ শতাংশ। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমখাতে বিদেশি বংশোদ্ভূত কর্মীর অংশগ্রহণ ছিল ৬৭ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব নাগরিকের অংশগ্রহণ ৬২ শতাংশ। বিদেশি বংশোদ্ভূতদের মধ্যে বৈধ অভিবাসী, শরণার্থী, অস্থায়ী বাসিন্দা এবং অনথিভুক্ত অভিবাসীরা অন্তর্ভুক্ত।
কোন খাতে কাজ করেন অভিবাসীকর্মীরা
বিএলএসের জরিপ বলছে, অভিবাসীরা বিভিন্ন শিল্প ও পেশায় কাজ করেন। মার্কিন অভিবাসীদের বড় সংখ্যায় পরিষেবা খাতে কাজ করে। এই খাতে তাদের অংশগ্রহণ ২২ শতাংশ। তাছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদ, নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে ১৩.৯ শতাংশ এবং উৎপাদন, পরিবহন ও উপকরণ স্থানান্তর খাতে ১৫.৫ শতাংশ অভিবাসীকর্মী যুক্ত রয়েছেন।
২০২৫ সালের একটি জাতীয় জরিপে দেখা গেছে, ১৮.৫ শতাংশ অভিবাসীকর্মী তাদের প্রাথমিক বা গৌণ কাজ হিসেবে চুক্তিভিত্তিক কাজে অংশ নেন। যারা সাধারণত উবারের মতো অ্যাপ-ভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কাজ পান; অথবা নির্মাণ ও উৎপাদনসহ শিল্পখাতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকেন।
অভিবাসীরা বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা করেন- যেমন স্থানীয় ছোট দোকান থেকে শুরু করে বৃহৎ আকারের উদ্যোগ পর্যন্ত। আমেরিকান ইমিগ্রেশন কাউন্সিলের মতে, ২০২৪ সালে ‘ফরচুন ৫০০’ তালিকায় স্থান পাওয়া ৪৬ শতাংশ কোম্পানিই অভিবাসীর সন্তানদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। এসব কোম্পানির মধ্যে অ্যাপল, অ্যামাজন এবং ডোরড্যাশের মতো কোম্পানিও রয়েছে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে আবিষ্কার ও উদ্ভাবনকাজে যুক্ত কর্মী ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ। তাদের মধ্যে ২৩ শতাংশই ছিল অভিবাসীর সন্তানদের দখলে।
মার্কিন অর্থনীতিতে ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির প্রভাব
ট্রাম্প প্রশাসন শরণার্থী পুনর্বাসন কর্মসূচি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে। অনিরাপদ দেশের তালিকায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। তাছাড়া নির্দিষ্ট ভিসা ফি বাড়ানোসহ বহু অভিবাসীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ মার্কিন শ্রমশক্তির ওপর প্রভাব ফেলেছে।
অভিবাসন নীতি কঠোর করার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের হোটেল, রেস্তোরাঁ, নির্মাণ এবং স্বাস্থ্যসেবা খাত সংকটে পড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটির ৬৮ শতাংশ কৃষি শ্রমিক ছিলেন বিদেশি বংশোদ্ভূত। চলতি বছরের অক্টোবরে শ্রম বিভাগ সতর্ক করেছিল, ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতি শ্রমিক ঘাটতি তৈরির ঝুঁকি তৈরি করছে। বিএলএসের তথ্যমতে, দেশব্যাপী ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে অভিবাসীকর্মী কমেছে দশ লাখের বেশি।
ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সসহ প্রশাসনের কিছু শীর্ষ কর্মকর্তার যুক্তি, অভিবাসন সীমিত করলে শ্রমিকের মজুরি বাড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী কর্মীদের জন্য আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র অ্যাবিগেল জ্যাকসন এক বিবৃতিতে বলেন, শ্রমশক্তি বৃদ্ধির জন্য মার্কিন নাগরিকের অভাব নেই।
তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, শ্রমশক্তি কমে গেলে তা অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও পরিষেবার পরিমাণও কমতে পারে। যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) একটি প্রধান উপাদান।
ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর আমেরিকান পলিসির (এনএফএপি) গবেষণায় বলা হচ্ছে, অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ ২০৩৫ সালের মধ্যে বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমাতে পারে। এনএফএপির সিনিয়র ফেলো মার্ক রেগেটস মনে করেন, অভিবাসীকর্মীরা উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, যা যুক্তরাষ্ট্রের সব জনগোষ্ঠীর জন্য সুবিধা বয়ে আনে।
যুক্তরাষ্ট্রে ১ কোটি ৪০ লাখ অনিবন্ধিত অভিবাসী রয়েছে। পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্স ২০২৪ সালে জানিয়েছিল, ১৩ লাখ থেকে ৮৩ লাখ অভিবাসীকে বহিষ্কার করলে ২০২৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত জিডিপি ৭ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পাবে। কর্মীদের ব্যাপকভাবে বহিষ্কার এবং বৈধ অভিবাসনে বিধিনিষেধ মার্কিন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সূত্র: মার্কিন থিংক ট্যাংক ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস’