ভারতকে দমাতে নতুন দক্ষিণ এশীয় জোট গড়তে চায় পাকিস্তান
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:২২ পিএম
পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, বাংলাদেশ, চীন ও ইসলামাবাদের মধ্যকার সাম্প্রতিক ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ, এমনকি এর বাইরের দেশগুলোকেও এতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
গত বুধবার ইসলামাবাদ কনক্লেভ ফোরামে তিনি বলেন, ‘আমরা… শূন্য-সমষ্টি পদ্ধতির (এক পক্ষের লাভের জন্য অন্য পক্ষের সমতুল্য ক্ষতি) বিরোধিতা করেছি এবং সংঘর্ষের পরিবর্তে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর ধারাবাহিকভাবে জোর দিয়েছি।’
বাস্তবে, দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন জোট সৃষ্টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এই প্রস্তাবে, যেখানে চীনও অন্তর্ভুক্ত হবে। এই প্রস্তাব এমন এক সময়ে এলো, যখন ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক উত্তেজনার কারণে কার্যত বিলুপ্ত হয়ে গেছে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক।
গত জুন মাসে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কূটনীতিকরা ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় অংশ নেন, যেখানে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনগণের জীবনযাত্রার উন্নতিতে জোর দেওয়া হয়। তারা বলেন, এটি এমন একটি সহযোগিতার সম্পর্ক, যা কোনো তৃতীয় পক্ষের দিকে পরিচালিত হয়নি।
ইসহাক দারের মন্তব্য ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের কয়েক দশক ধরে চলা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধির পটভূমিতে এসেছে। গত মে মাসে দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী চার দিনের বিমানযুদ্ধে লিপ্ত হয়, যা সম্পর্কে আরো টানাপোড়েন তৈরি করে।
এদিকে গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে সম্পর্কের তীব্র অবনতি ঘটে। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান এবং নয়াদিল্লি এখন পর্যন্ত তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অথচ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্য বেশির ভাগ দেশ এমন একটি নতুন আঞ্চলিক জোট গঠনে সম্মত হবে কি, যার লক্ষ্য ভারতকে বিচ্ছিন্ন করা অথবা প্রভাব সীমিত করা?
পাকিস্তানের প্রস্তাব কী?
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের লক্ষ্য হলো অভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রে ‘পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি’ এবং ধারণাটিকে ‘সম্প্রসারিত ও অনুকরণ’ করা, যাতে আরো দেশ ও অঞ্চল এতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
তিনি বলেন, ‘আমি আগে যেমনটা বলেছি, অর্থনীতি থেকে প্রযুক্তি ও সংযোগের মতো বিষয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশ এখানে থাকতে পারে।’
ইসহাক দার আরো বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব জাতীয় উন্নয়নের চাহিদা এবং আঞ্চলিক অগ্রাধিকার কারো কাছে জিম্মি হতে পারে না এবং করা উচিত নয়।’ তিনি ভারতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আপনি জানেন যে আমি কার কথা বলছি।’
ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মধ্যে উত্তেজনা প্রসঙ্গে ইসহাক দার বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি ‘কাঠামোগত সংলাপ প্রক্রিয়া ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে’ অচলাবস্থায় রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে অন্যান্য আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর একটি তিক্ত সম্পর্ক রয়েছে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান এমন একটি দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন দেখে যেখানে সংযোগ ও সহযোগিতা বিভাজনকে প্রতিস্থাপন করে, অর্থনীতি সমন্বয়ের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায়, আন্তর্জাতিক বৈধতা অনুসারে বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা হয় এবং যেখানে শান্তি মর্যাদা ও সম্মানের সাথে বজায় থাকে।’
লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের (সিএসএসপিআর) পরিচালক রাবিয়া আখতারের মতে, এই পর্যায়ে প্রস্তাবটি সম্ভবত ‘কার্যক্ষমতার চেয়ে বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী’।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু এটি এমন এক সময়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা ব্যবস্থাকে বৈচিত্র্যময় এবং পুনর্কল্পিত করার পাকিস্তানের ইচ্ছার ইঙ্গিত দেয়, যখন সার্ক এখনো অচল।’
আঞ্চলিক সংস্থা সার্ক কী?
১৯৮৫ সালে ঢাকায় এক শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সার্ক। এর সাত প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। ২০০৭ সালে আফগানিস্তান অষ্টম সদস্য হিসেবে এতে যোগ দেয়।
এর ওয়েবসাইট অনুসারে, সার্কের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশীয়দের কল্যাণ এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটানো।
উচ্চাকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও সংস্থাটি গত ৪০ বছর ধরে তার লক্ষ্য অর্জনে লড়াই করেছে, যার জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দশকব্যাপী উত্তেজনা দায়ী।
২০১৬ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন, যা ভারত-শাসিত কাশ্মীরে এক প্রাণঘাতী হামলার কারণ দেখিয়ে ভারত প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর এবং পাকিস্তানকে দায়ী করার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়।
রাবিয়া আখতার বলেন, ‘সংগঠনের কাজ করার জন্য ঐকমত্য প্রয়োজন এবং দ্বিপক্ষীয় বিরোধ থেকে আঞ্চলিক সহযোগিতা আলাদা করার জন্য দুই বৃহত্তম সদস্যের রাজনৈতিক ইচ্ছা ছাড়া সার্ক এগিয়ে যেতে পারে না।’
আঞ্চলিক সংস্থার শেষ শীর্ষ সম্মেলন ২০১৪ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সার্ক সুপ্ত থাকলেও, এই সংস্থাটি অঞ্চলের জন্য কিছু করার সম্ভাবনা রাখে যদি ভারত ও পাকিস্তান অনুমতি দেয়।
সার্ক কেন গুরুত্বপূর্ণ
২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলোর জনসংখ্যা ২০০ কোটিরও বেশি। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, তবুও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য খুবই কম, যা এই অঞ্চলের সামগ্রিক বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ বা প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে প্রায় ৭০ কোটি জনসংখ্যার ১১টি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশের জোট আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাণিজ্য তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ২৫ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের অনুমান, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো যদি বাধা কমিয়ে আনে, তাহলে তারা ৬৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য বিনিময় করতে পারত; যা তাদের বর্তমান বাণিজ্যের তিনগুণ।
বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য হতাশাজনক রয়ে গেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য ছিল মাত্র ২.৪১ বিলিয়ন ডলার। এটি ২০২৪ সালের মধ্যে ১.২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের (অন্য দেশের মধ্য দিয়ে পরিবহন) পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার।
আঞ্চলিক সংযোগের অভাবকে এই অঞ্চলের দুর্বল বাণিজ্য সংযোগের একটি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
২০১৪ সালে সার্ক একটি মোটরযান চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত ছিল, যার মাধ্যমে ইউরোপের মতো দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে গাড়ি এবং ট্রাক চলাচল করতে পারত। কিন্তু ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তান সেই চুক্তি এবং আঞ্চলিক রেলওয়ে সহযোগিতার ওপর একটি পৃথক চুক্তি আটকে দেয়।
এরপর থেকে এই জোটের একত্রিত হওয়ার ক্ষমতা সীমিত হয়ে যায়। কোভিড-১৯ মহামারির সময় যখন সদস্য দেশগুলো একটি জরুরি তহবিল গঠন করেছিল এবং জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবেলায় ৭.৭ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছিল।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের (এএসপিআই) দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক
ফারওয়া আমের বলেন, ‘যদি দুটি দেশ (ভারত এবং পাকিস্তান) বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থের জন্য সহযোগিতার জন্য এমনকি সীমিত উপায়গুলোও চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়, তাহলে নীতিগতভাবে সার্ক পুনরুজ্জীবিত হতে পারে।’
এই বিশ্লেষক বলেন, ‘তবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে, এই ধরনের অগ্রগতি একটি দূরবর্তী সম্ভাবনা বলে মনে হচ্ছে।’
কিন্তু পাকিস্তানই প্রথম দেশ নয় যারা আঞ্চলিক অংশীদারত্ব গড়ে তোলার জন্য সার্ককে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সার্ক একটি আঞ্চলিক পরিবহন চুক্তি অনুমোদন করতে ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের আদ্যক্ষর অনুসারে বিবিআইএন নামের একটি জোট গড়ে নিজেদের মধ্যে একই ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর করে।
আমির বলেন, ভারতও বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশনের (বিআইএমএসটিইসি) মতো অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থার অংশ। এতে ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
পাকিস্তানের প্রস্তাব কি কাজ করবে
শিক্ষাবিদ আখতার বলেন, প্রস্তাবটি কাজ করবে কি না, তা দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে।
তিনি বলেন, প্রথমত, ঐতিহ্যবাহী কাঠামো স্থবির হয়ে পড়ায় সম্ভাব্য রাষ্ট্রগুলো ছোট ও ইস্যুকেন্দ্রিক জোটের কার্যকর মূল্য দেখতে পায় কি না; এবং দ্বিতীয়ত, এতে অংশ নিলে রাজনৈতিকভাবে চড়া মূল্য দিতে হয় কি না।’
আখতার বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ পাকিস্তানের প্রস্তাবিত আঞ্চলিক উদ্যোগে আংশিক আগ্রহ দেখাতে পারে। যদিও আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণের দিকে যেকোনো পদক্ষেপ সীমিত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ ও সম্ভবত ভুটানের মতো দেশ অনুসন্ধানমূলক অংশগ্রহণের জন্য উন্মুক্ত থাকতে পারে, বিশেষ করে সংযোগ, জলবায়ু অভিযোজন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতার ক্ষেত্রে।’
তবে আখতার উল্লেখ করেছেন, ভারতের আঞ্চলিক সংবেদনশীলতা এবং পাকিস্তান ও চীনের সাথে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অর্থ হলো প্রকৃত সদস্যপদ গ্রহণ সতর্কতার সাথে করা হবে।’
তবুও আমির বিশ্বাস করেন, পাকিস্তানের প্রস্তাবটি ‘কৌশলগতভাবে সুসংগত’।
‘দেশটি কূটনৈতিক তৎপরতার মুহূর্তে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান চীনের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রেখেছে, একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং উপসাগরীয় অঞ্চলের সাথে নবায়নযোগ্য ও উন্নত সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।’
তিনি বলেন, ‘এই দ্বৈত-পর্যায়ের সম্পৃক্ততা ইসলামাবাদকে আত্মবিশ্বাসের অনুভূতি এবং আঞ্চলিক কূটনীতির কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পুনরুদ্ধারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক চালক হিসেবে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দিয়েছে।’