Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

দেশের অর্থনীতিকে যেভাবে গিলে খাচ্ছে পাকিস্তানের অভিজাত শ্রেণি

Icon

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৫৬ এএম

দেশের অর্থনীতিকে যেভাবে গিলে খাচ্ছে পাকিস্তানের অভিজাত শ্রেণি

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নতুন এক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, পাকিস্তানে দুর্নীতিই বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ। দেশটিতে ‘স্টেট ক্যাপচার’ অর্থাৎ রাষ্ট্রের নীতি এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, যাতে অল্পসংখ্যক রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক এলিটদের স্বার্থ পূরণ হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির চলমান আর্থিক সংকটের মূল কারণ হলো রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ‘স্টেট ক্যাপচার’, যেখানে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক অভিজাতদের স্বার্থে সরকারি নীতি বিকৃত হচ্ছে। 

নভেম্বর ২০২৫ সালে চূড়ান্ত হওয়া শাসন ও দুর্নীতি নির্ণয় প্রতিবেদন দেশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং দুর্নীতির বিস্তৃত প্রভাবকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আইনের শাসন প্রয়োগে এবং জনসম্পদ রক্ষায় যথাযথ কার্যকর নয়। 

দুর্নীতির বিস্তার ও প্রভাব

প্রতিবেদনে পাকিস্তানে দুর্নীতি ‘দূরপ্রসারী ও ক্ষয়কারী’ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। এটি বাজারকে বিকৃত করছে, জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ণ করছে এবং আর্থিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করছে। 

পাকিস্তান সরকারের অনুরোধে তৈরি প্রতিবেদন সতর্কভাবে জানিয়েছে যে, ‘অভিজাত শ্রেণির বিশেষাধিকার’ ভেঙে না দেওয়া হলে দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতা অব্যাহত থাকবে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদিও সরকারি স্তরের সবখানে দুর্নীতির ঝুঁকি রয়েছে, তবে সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো সেই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত সত্তা যারা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতে প্রভাব বিস্তার করে, যার অধিকাংশই রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত বা রাষ্ট্র-সম্পৃক্ত। 

আরও পড়ুন
আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শাসনব্যবস্থা উন্নয়ন এবং জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করা হলে পাকিস্তান উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক লাভ পেতে পারে। এসব সংস্কারের ফলে দেশের জিডিপি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে, যা ২০২৪ সালে ছিল ৩৪০ বিলিয়ন ডলার। 

আইএমএফ অনুমান করছে, সুশাসনের একটি সমন্বিত সংস্কার প্যাকেজ বাস্তবায়ন করলে পাকিস্তানের জিডিপি পাঁচ থেকে ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

পাকিস্তান সরকারকে অর্থনৈতিক সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক নীতির অধ্যাপক স্টেফান ডারকন বলেন, দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার জবাবদিহিতার অভাব দেশটির অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে ক্ষয় করছে। 

তিনি বলেন, আইন ও জবাবদিহিতা ব্যবস্থার বাস্তবায়নে ব্যর্থতা স্বার্থান্বেষী মহলকে সীমাহীন সুযোগ দেয় এবং এটি অর্থনৈতিক সংস্কারের কেন্দ্রে থাকা উচিত।

রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা 

প্রতিবেদনে ‘স্টেট ক্যাপচার’ ধারণাটিকে কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দিয়েছে। সংস্থাটির মতে, যেখানে দুর্নীতি নিয়মে পরিণত হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রায়শই নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে জনগণের ক্ষতি করছে। 

বিশেষ বিনিয়োগ সুবিধা কাউন্সিল (SIFC), যা জুন ২০২৩-এ গঠিত হয়েছে, বিনিয়োগ সহজ করার জন্য বিস্তৃত ক্ষমতা পেয়েছে। তবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই সামরিক বাহিনী থেকে আসা এবং তারা আইনি দায়মুক্তি পাচ্ছেন। প্রতিবেদন বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। 

বিচারব্যবস্থা ও আইনের শাসন 

পাকিস্তানে দুই মিলিয়নেরও বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা ৭ শতাংশ বেড়েছে। দুটি সাংবিধানিক সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা হ্রাস করেছে এবং বিচারক নিয়োগ ও স্থানান্তরের নিয়মে পরিবর্তন এনেছে। যদিও সরকার বলছে, এই পরিবর্তনগুলো বিচারব্যবস্থার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য করা হয়েছে। 

আরও পড়ুন
দুর্নীতি দমন সংস্থা ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো  (এনএবি) কখনও কখনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবেদনে এনএবি-র নিয়োগ প্রক্রিয়ার মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। 

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ 

লাহোর ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক আলী হাসানাইন বলেছেন, আইএমএফের পর্যবেক্ষণ সঠিক হলেও নতুন নয়। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশীয় গবেষকরা বহু বছর ধরে একই ধরনের সুপারিশ করে আসছেন। 

ইসলামাবাদের ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট পলিসি ইনস্টিটিউট (এসডিপিআই)’ এর জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ সাজিদ আমিন জাভেদ বলেন, দুর্নীতি ও শাসন ব্যবস্থা একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। দুর্নীতি দুর্বল শাসন তৈরি করে, এবং দুর্বল শাসন আবার দুর্নীতিকে বৃদ্ধি করে।

আরও পড়ুন
বিশেষজ্ঞরা একমত যে সমস্যার প্রকৃতি রাজনৈতিক, শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সুশাসনের সংস্কার কেবল অস্থির ভিত্তির উপর দাঁড়ানো সমাধান হয়ে থাকবে। 

সমাধান ও সুপারিশ 

হাসানাইন প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে একটি একীভূত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামো “কমিটি, কাউন্সিল, টাস্কফোর্স ও ওভারল্যাপিং মন্ত্রণালয়ে” বিভক্ত, যেখানে প্রত্যেকে নিজের মতো নথি তৈরি করে কিন্তু জবাবদিহিতা নেই। 

জাভেদ আরও বলেন, সরকারি ক্রয়ব্যবস্থা সংস্কার করা সবচেয়ে তাৎক্ষণিক অগ্রাধিকার। 

তিনি বলেন, ক্রয়ব্যবস্থা অর্থের মান নয়, বরং অর্থের পরিমাণকে অগ্রাধিকার দেয়। এতে প্রকৃত যোগ্য প্রতিষ্ঠান চুক্তি পায় না। আধুনিকায়ন অপরিহার্য।

বিশেষজ্ঞরা একমত, পাকিস্তানকে স্বচ্ছ, শক্তিশালী ও উন্নত অর্থনীতির দিকে নিয়ে যেতে হলে পুরো অর্থনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠন ছাড়া বিকল্প নেই।

আল–জাজিরা ইসলামাবাদের লেখক আবিদ হুসাইনের লেখাটি ভাষান্তর করেছেন মিশর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী- জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান  

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার