কারাগারে বন্দির সঙ্গে প্রেম, যৌন সম্পর্ক, অতঃপর...
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৩০ পিএম
২০২২ সালের গ্রীষ্মের এক দিন। ডরসেটের এইচএমপি দ্য ভার্ন কারাগারের ডে-রুমে দাঁড়িয়ে ছিলেন ২৬ বছরের কারা কর্মকর্তা শেরি-অ্যান অস্টিন-স্যাডিংটন। সেখানেই তাকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একজন বন্দি ব্র্যাডলি ট্রেঙ্গ্রোভ তাকে একটি ম্যাগাজিন দিল। এর ভেতরে লুকানো ছিল তার অবৈধ মোবাইল ফোনের নম্বর। শেরি অ্যান বলেন, আমি ভাবছিলাম রিপোর্ট করব? নাকি করব না? মনে কোনওভাবেই ছিল না যে আমি তাকে মেসেজ করব।
কিন্তু তিনি কাগজটি ফেলে দেননি। রেখে দেন। আর সেখান থেকেই শুরু হয় একদফা ভুল সিদ্ধান্ত। সেই ভুল তাকে প্রাসাদসম ভবিষ্যৎ থেকে টেনে নিয়ে যায় এক বন্দির সঙ্গে যৌন সম্পর্কে। শেষ পর্যন্ত তাকেও পরিণত করে একজন দণ্ডিত অপরাধীতে। শেরি-অ্যান বলেন এটি এমন একটি সিদ্ধান্ত, যার জন্য তিনি সারাজীবন অনুতপ্ত থাকবেন। আর তার গল্পটি তুলে ধরে যে, বৃটেনের কারা ব্যবস্থার কোথায় কোথায় ভয়াবহ দুর্বলতা আছে, কীভাবে কর্মীদের নিয়োগ ও তদারকিতে বড়সড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে।
২০১৯ থেকে ২০২৪। এই পাঁচ বছরে কমপক্ষে ৬৪ জন কারা কর্মকর্তাকে বন্দিদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোর কারণে বরখাস্তের সুপারিশ করা হয়। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। কারণ অনেকে বরখাস্ত হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেন। অনেকে অন্য দপ্তরের কর্মী, আর অনেকে ধরা-ই পড়েন না। সমস্যাটি কেবল কিছু ব্যক্তিগত ভুল সিদ্ধান্ত নয়। এটি একটি ব্যবস্থাগত সংকট। বিশেষ করে নারী কারা কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে, যারা বিপজ্জনক পুরুষ বন্দিদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। গত এক বছরেই কমপক্ষে দশজন নারী এই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন। কারও ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। কেউ কাপবোর্ডে আটক অবস্থায় ধরা পড়েছেন। কেউ আবার উচ্চপ্রোফাইল বন্দির সঙ্গে সম্পর্কের কারণে দীর্ঘ সাজা পেয়েছেন।
এই ভিড়ে শেরি-অ্যানের গল্পটি আলাদা। তিনি জানতেন, ট্রেঙ্গ্রোভ একজন দণ্ডিত যৌন অপরাধী। ২০২৩ সালের মে মাসে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারণ তিনি চেষ্টা করছিলেন বন্দির কাছে ক্যালপল সিরিঞ্জ পৌঁছে দিতে, যাতে ট্রেঙ্গ্রোভ তার শুক্রাণু দিয়ে তাকে কৃত্রিমভাবে গর্ভধারণ করাতে পারে। আর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সম্পর্ক শেষ হওয়ার নয় মাস পরে হঠাৎই শেরি-অ্যান স্পাইনাল স্ট্রোকে প্যারালাইজড হয়ে পড়েন। বুকের নিচ থেকে সারা জীবন চলাফেরায় অক্ষম হয়ে পড়েন। তাই তার দুই বছরের সাজা স্থগিত করা হয়।
শেরি অ্যানের বয়স এখন ২৯ বছর। তিনি বলেন, আমি জানি আমি জেলে যাইনি। কিন্তু আমি সারা জীবনের জন্য এই শরীরের ভেতরেই বন্দি। তিনি অসহায় ছিলেন। ছোটবেলায় এক কন্যাসন্তানের মা হন ১৬ বছর বয়সে। পরে কাজ, প্রশিক্ষণ, সম্পর্ক- সব মিলিয়ে জীবনে নানা টানাপোড়েন। ২০১৯-এ তিনি কারা কর্মকর্তা হন। দ্য ভার্ন কারাগারটি মূলত যৌন অপরাধীদের প্রতিষ্ঠান। এখানে বন্দিরা বয়সে বড়, আচরণে শান্ত। কিন্তু ভেতরে অত্যন্ত চালাক ও প্রভাবশালী। ট্রেঙ্গ্রোভ তাকে চুপিসারে কাছে টানতে শুরু করে। একদিন একটি ম্যাগাজিন চেয়ে, আরেকদিন সামান্য প্রশংসা করে। তারপর বাড়তে থাকে মেসেজ, অতি ব্যক্তিগত মন্তব্য, মিথ্যে গল্প, আবেগী নাটক, পরিবার-পরিজনের নামে বিশ্বাস অর্জন। শেরি-অ্যান বলেন- মনে হচ্ছিল আমি যেন নতুন একটি পরিবার পেয়ে গেছি।
কিন্তু আসলেই তিনি যাচাই করে দেখেননি যে কে এই ট্রেঙ্গ্রোভ। তিনি ছিলেন- এক কিশোরীকে বারবার ধর্ষণের অপরাধে ১৩ বছরের সাজাপ্রাপ্ত একজন অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যক্তি। শেরি-অ্যানের ভাষায়- আমি ভাবতাম আমি যথেষ্ট নই। তাই যিনি আমাকে ভালোবাসবে বলছে, তাকে সব দিয়ে দিতে হবে। সম্পর্কটি বাড়তে থাকে। কয়েকবার যৌন সম্পর্ক হয়। এরপর তিনি গর্ভবতী হন।
কয়েক সপ্তাহ পর গর্ভপাত। আর ট্রেঙ্গ্রোভের রাগ, আবেশ, নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়ে। কারাগার থেকে বেরোলেই তাকে ফোন ধরতে হতো। ঘুমাতে যাওয়ার অনুমতিও সে দিত।
এদিকে তার বার্তালাপ ধরা পড়ে। ট্রেঙ্গ্রোভকে অন্য কারাগারে পাঠানো হয়। শেরি-অ্যান পদত্যাগ করেন। কিন্তু সম্পর্ক তখনও শেষ হয়নি। ট্রেঙ্গ্রোভ তাকে নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য করে, যাতে নতুন কারাগারে দেখা করতে পারে। এক পর্যায়ে সে তাকে বলে- ক্যালপল সিরিঞ্জ এনে দাও।
যা নিয়ে আসার চেষ্টা করতেই তিনি গ্রেপ্তার হন। এত কিছুর পরও প্রেম, হুমকি, আবেগী চাপ- সব মিলিয়ে সম্পর্কটা আরও দুই সপ্তাহ টিকে থাকে। এরপর পুলিশ তাকে ট্রেঙ্গ্রোভের প্রকৃত অপরাধের বিবরণ দেখালে, সব সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। ২০২৪ সালে তিনি ট্রেঙ্গ্রোভের পাঠানো রক্তমাখা ১০ পাতার চিঠিও পান। সেখানে ওই বন্দি লিখেছে, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।
কারা কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর জনবল সংকটে। অল্প প্রশিক্ষণে তরুণী নারীদের অত্যন্ত বিপজ্জনক পুরুষ বন্দিদের তত্ত্বাবধানে পাঠানো হচ্ছে। কোথাও দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যবস্থাপনা, কোথাও তদারকির ঘাটতি- সব মিলিয়ে প্রহরীদের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে। শেরি-অ্যান বলেন, অনেকে কাজ খুঁজে না পেয়ে এই চাকরিতে আসেন। কর্তৃপক্ষ এত কম স্টাফ নিয়ে চলে যে তাদের কাছে থাকা কর্মকর্তাদের দিকেও সঠিকভাবে নজর দেয়া হয় না।