যুক্তরাজ্যের শরণার্থী নীতি, আশ্রয়প্রার্থীর ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে
আল জাজিরা
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:৫৭ পিএম
যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ বলেছেন, তাদের আশ্রয় দেওয়ার নীতি আর কাজ করছে না। এটি কমিউনিটিগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে। তিনি নীতিটির বড় ধরনের সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মাধ্যমে শরণার্থীদের স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকারের ইতি ঘটবে।
শাবানা মাহমুদের প্রস্তাবের দুটি প্রধান দিক আছে। প্রথমত, এর মাধ্যমে শরণার্থীদের পাঁচ বছর পর স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদনের পথ বন্ধ হবে। দ্বিতীয়ত, যাদের কাজ করার অধিকার আছে তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতা বাতিল করা হবে।
অবৈধভাবে ফ্রান্স থেকে সাগরপথে অভিবাসীদের ঢল কমানোর পরিকল্পনার কথাও বলেছেন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পাশাপাশি বলেছেন, আশ্রয় নেওয়ার পর কারও দেশ যদি নিরাপদ মনে হয় তাহলে তাকে ফেরত পাঠানো হবে।
অভিবাসী ঢলের বর্তমান চিত্র
যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের (ওএনএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে প্রতি বছর দুই থেকে তিন লাখ অভিবাসী আশ্রয় নিয়েছেন। তবে ২০২০ সালে ব্রেক্সিট কার্যকরের পর নথিহীন অভিবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। ২০২৩ সালের জুনের হিসাব অনুযায়ী, নিট অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৯ লাখ ৬ হাজার। প্রবেশকারী থেকে ছেড়ে যাওয়ার সংখ্যা বিয়োগ করে এমন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়।
তবে সাম্প্রতিক হিসাব এক ভিন্ন ছবি তুলে ধরছে। ২০২৪ সালে নিট অভিবাসী অর্ধেকেরও বেশি কমে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩১ হাজারে। এর মূল কারণ হলো গত বছর স্বাস্থ্যখাত ও শিক্ষার্থী ভিসার সংখ্যা কমিয়ে আনা।
অপরদিকে, সাগর পথে যাওয়া অভিবাসীর সংখ্যা খুবই কম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, ছোট নৌকায় করে যুক্তরাজ্যে যাওয়া অভিবাসীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৬ হাজার ৮১৬ জন। গত বছর ১ লাখ ৮ হাজার ১৩৮ জন আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছিলেন। তাদের মধ্যে নৌকায় করে যাওয়া শরণার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র এক তৃতীয়াংশ। অর্থাৎ, বেশিরভাগ আশ্রয় প্রার্থীরা বৈধ ও নিয়মিত চ্যানেলের মাধ্যমে আবেদন করেছিল (কিছু ছিল আগে থেকেই অবস্থানকারী পরিবারের সদস্য)।
অভিবাসীর সংখ্যা কমলেও ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির ওপর স্থানীয়দের অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। গত আগস্টে একটি জরিপ চালায় ইউগভ নামের একটি সংস্থা। এতে দেখা গেছে, ৩৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন লেবারের চেয়ে দক্ষিণপন্থী রিফর্ম ইউকে পার্টি অভিবাসন সমস্যা আরও ভালোভাবে সামলাতে পারবে। বিপরীতে লেবারের ওপর আস্থা রেখেছেন মাত্র ৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী।
সরকার যে পরিবর্তন চায়
নাগরিকত্বের অধিকার: শরণার্থীদের স্থায়ী বসবাসের অধিকার বাতিল করে ‘অস্থায়ী সুরক্ষা’ মডেল তৈরি করতে চায়। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, আশ্রয়প্রাপ্তরা পাঁচ বছর থাকার পর স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদন করতে পারেন। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০ বছরের আগে এই আবেদন করা যাবে না। পাশাপাশি প্রতি আড়াই বছর পর শরণার্থী মর্যাদা পুনঃমূল্যায়ন করা হবে। তাতে শরণার্থীর নিজের দেশ নিরাপদ মনে হলে ফেরত পাঠানো হবে।
সামাজিক অধিকার : শাবানা মহমুদ জানিয়েছেন, আশ্রয়প্রার্থীদের বাসস্থান ও মৌলিক আর্থিক সহায়তার সুবিধা সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতার আইন বাতিল করতে চান। যারা কাজ করতে সক্ষম এবং যারা অপরাধ বা ফিরে যাওয়ার আদেশ অমান্য করবে তাদের সহায়তা দেওয়া হবে না।
অধিকার কর্মীরা যা বলছেন
শরণার্থী কাউন্সিলের প্রধান নির্বাহী এনভার সোলোমন বলেন, নাগরিকত্ব পাওয়ার ২০ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা অনিশ্চয়তা তৈরি করবে। শরণার্থীদের মধ্যে চরম উদ্বেগ দেখা দেবে। বিবিসির এক অনুষ্ঠানে সোলোমন আরও বলেন, এখানে নিয়ন্ত্রিত ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা দরকার। সে জন্য আপনাকে সিদ্ধান্তটাও ন্যায়সঙ্গত উপায়ে নিতে হবে।
আড়াই বছর পর পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ধারনাটি ডেনমার্কের বিতর্কিত নীতিমালা থেকে অনুপ্রাণিত। যদিও ডেনমার্কের ফরেন পলিসি ইয়ারবুকের গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের হুমকি শরণার্থী ঢলে বড় প্রভাব ফেলে না। ২০১৭ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, অভিবাসন নিয়ে নেতিবাচক প্রচারের পরও আবেদনের হার তেমন কমেনি।
যুক্তরাজ্যের অন্যান্য প্রস্তাব
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার: বৈধ নথি ছাড়া দেশটিতে যাওয়া ব্যক্তিদের বয়স নির্ধারণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভিত্তিক পদ্ধতি চালু করতে চায় ব্রিটিশ সরকার। সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমান ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে প্রাপ্তবয়স্কদের ভুল করে অপ্রাপ্তবয়স্কের সুবিধা দেওয়া হয়। আবার কখনো এর বিপরীতটা ঘটে।
তবে অধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহারে পক্ষপাতিত্ব বাড়তে পারে। ভুলক্রমে শিশুদের প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে চিহ্নিত করলে তা মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনবে। চলতি বছরের শুরুতে শরণার্থী কাউন্সিলের প্রধান নির্বাহী বিবিসিকে বলেছিলেন, এআই দিয়ে বয়স নির্ধারণ সঠিক পদক্ষেপ নয়। এই প্রযুক্তিগুলোর যথাযথভাবে কাজ করা নিয়ে এখনো প্রশ্ন আছে।
তিন দেশে ভিসা নিষেধাজ্ঞা : যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অ্যাঙ্গোলা, নামিবিয়া ও কঙ্গোর সরকার তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে সহযোগিতা না করলে এসব দেশের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। যাদের ফেরত নিতে বলা হবে তাদের মধ্যে আছে অপরাধী ও অনিয়মিত অভিবাসী।
পরিবারের দাবি পর্যালোচনা : ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশনের (ইসিএইচআর) পরিবারিক অধিকার সম্পর্কিত নীতি অনুসরণ করা কমানো হবে। এর ফলে, পারিবারিক সংযোগ বলতে কেবল মা-বাবা ও সন্তানকে বোঝানো হবে। এর বাইরে কেউ নয়।
আশ্রয়প্রার্থীদের নতুন পথ কী
ইউক্রেনের পাশাপাশি আফগানিস্তানের নাগরিকরা বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে বৈধভাবে বসবাসের অধিকার, কাজ করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ পান। এ ছাড়া, এমন সুযোগ পান হংকংয়ের ব্রিটিশ ন্যাশনাল ওভারসিজ (বিএনও) ভিসাধারীরা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন সংস্থা বলছে, সীমিত ভিসা স্কিম ও কঠোর নীতি অনেক মানুষকে অবৈধ পথ বেছে নিতে বাধ্য করে। তাই ব্রিটিশ সরকারের কাছে বৈধ পথ সম্প্রসারণের (যেমন- পুনর্বাসন স্কিম, পারিবারিক পুনর্মিলন, কমিউনিটি স্পনসরশিপ) আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে মানবপাচার ও যাত্রাপথে মৃত্যুহার কমবে। একটি সম্ভাব্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে ‘হোমস ফর ইউক্রেন’ স্কিমের আদলে। এর মাধ্যমে আশ্রয়প্রার্থীর আবাসন ও পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব নেবে স্থানীয় কমিউনিটি।