ডেনমার্কের মতো কঠোর অভিবাসন আইন করতে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য?
ইনফোমাইগ্রেন্টস
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:৩২ এএম
চলমি মাসের শেষদিকে যুক্তরাজ্যের অভিবাসন এবং আশ্রয়প্রদান সংক্রান্ত আইনের পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ৷
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জন্য প্রণোদনা প্রদান কমিয়ে আনা এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজ করা এমন সব বিষয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণায় থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ ব্রিটিশ সরকারের এই নতুন আইন অনেকটা ইউরোপের আরেক দেশ ডেনমার্কের আদলে হতে পারে৷ উল্লেখ্য, ডেনমার্কের অভিবাসন আইন ইউরাপে কঠোর আইনগুলোর একটি- এমনটা বলা হয়ে থাকে৷
ব্রিটেনের সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে যা প্রয়োজন তা-ই করা হবে, দায়িত্ব নেওয়ার পর এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ৷ অবশ্য দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময়ই এমন প্রচারণা দেখা গিয়েছিল৷
এরপর প্রতিনিয়ত আশ্রয়প্রদান এবং শরণার্থী বিষয়ে নতুন নতুন আইন করেছে যুক্তরাজ্য৷ তবে এবার অভিবাসন নিয়ে নতুন কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে দেশটি৷ ইউরোপের অন্য দেশগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এই বিষয়ে নিজেদের আইনি অবস্থান স্পষ্ট করতে চায় যুক্তরাজ্য৷
যেমন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ জানিয়েছেন, ডেনমার্কের অভিবাসন আইনের বিষয়ে জানতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দলকে সেখানে পাঠানো হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘ডেনমার্ক যেভাবে আশ্রয় আবেদন গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে সেই বিষয়টি দেখে তিনি অনুপ্রাণিত৷’’
তিনি জানান, অভিবাসন এবং আশ্রয়প্রদান বিষয়ে তার দেশের কিছু বিধি ডেনমার্কের আদলে করার পরিকল্পনা করছেন৷ বিশেষ করে পারিবারিক পুনর্মিলন এবং শরণার্থীদের বিষয়াদি৷
উল্লেখ্য, গত কিছু দিনে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে প্রায় ১৭শ অভিবাসনপ্রত্যাশী যুক্তরাজ্যে পৌঁছেছেন৷ ঠিক এই সময়েই অভিবাসন এবং আশ্রয়প্রদান বিষয়ক আইনে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন শাবানা মাহমুদ৷ চলতি বছর এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৮ হাজারের বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে পৌঁছেছেন৷
ডেনমার্ককে অনুসরণ করবে ব্রিটেন?
অভিবাসন এবং আশ্রয়প্রদান বিষয়ে নিজের পরিকল্পনার বিস্তারিত জানাননি শাবানা মাহমুদ৷ তবে ধারণা করে হচ্ছে, নতুন আইনের লক্ষ্য থাকবে আশ্রয়প্রার্থী এবং শরণার্থীরা৷
নিজ দেশে নির্যাতন বা সংঘাত থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদেরকে সুরক্ষার মর্যাদা দিয়ে থাকে ডেনমার্ক৷ তবে বর্তমানে তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেওয়া হয়ে থাকে৷ এরপর ড্যানিশ সরকার ওই দেশকে নিরাপদ মনে করলে আশ্রয়প্রার্থীকে ফেরত পাঠাতে পরে, যদি তারা স্বেচ্ছায় না-ও যেতে চায়৷ যেমন ড্যানিশ সরকার বর্তমানে সিরীয় আশ্রয়প্রার্থীদের বিষয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করতে যাচ্ছে৷ কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের ওই দেশটিতে গৃহযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়েছে৷
তবে কোনো কোনো দেশে সংঘাত বছরের পর বছর বা দশক ধরে চলতে থাকে বলে আশ্রয়প্রার্থীদের নিয়মিতকরণের প্রক্রিয়া রয়েছে, তবে তা সীমিত পরিসরে৷ এক্ষেত্রে ড্যানিশ সরকারের কিছু আইন অনুসরণ করতে পারে যুক্তরাজ্য৷ যেমন স্থায়ী বসবাসের অনুমতি প্রদানের সময়সীমা বাড়ানো৷ সেইসাথে তা শর্তসাপেক্ষ করা৷ যেমন আশ্রয়প্রার্থীর পূর্ণকালীন চাকরি থাকতে হবে এমন শর্ত৷
পারিবারিক পুনর্মিলনে কঠোর ড্যানিশ আইন
জানা গেছে, পারিবারিক পুনর্মিলন বিষয়ে ড্যানিশ সরকারের প্রণীত আইনের প্রতি আগ্রহ রয়েছে ব্রিটিশ প্রশাসনের৷ অর্থাৎ ডেনমার্ক সরকারের আদলে অভিবাসী কিংবা আশ্রয়প্রার্থীদের পারিবারিক পুনর্মিলনের বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে ব্রিটিশ প্রশাসন৷
আশ্রয় প্রক্রিয়ায় পারিবারিক পুনর্মিলনের বিষয়টি যেন যথাযথ হয় অর্থাৎ সেখানে যেন কোনো ধরনের সুবিধা নেওয়ার বিষয় জড়িত না থাকে, তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করেছে ড্যানিশ সরকার৷ যেমন, সরকার বলছে, বসবাসের অনুমতি পাওয়া শরণার্থী যদি বিয়ে করতে চায় তাহলে তার বয়স অবশ্যই ন্যূনতম ২৪ হতে হবে৷
তাছাড়া, দম্পতিদের একজন ডেনমার্কে অবস্থান করলে এবং অন্যজন অন্য কোনো দেশে অবস্থান করলে ডেনমার্কে অবস্থানরত ওই অভিবাসী বিয়ের জন্য অনুমতি পেতে বিয়ের আগের তিন বছর সরকারের কাছ থেকে কোনো ভাতার সুবিধা নিতে পারবে না এমন অবস্থা থাকতে হবে৷ এই ধারা অনুসরণ করতে চায় ব্রিটিশ সরকারও৷
তাছাড়া বিয়ের সনদ পাওয়ার জন্য দম্পতিদের উভয়কেই ড্যানিশ ভাষায় দক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে৷
দেশে ফেরত যেতে আশ্রয়প্রার্থীদের প্রণোদনা
ডেনমার্কের ইমিগ্রেশন এবং ইন্টিগ্রেশন বিষয়ক মন্ত্রী রাসমোস স্টোকলুন্ড জানান, অভিবাসন আইন শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি৷ তবে ড্যানিশ সরকার চাইছে তা ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন শুরু হোক৷
তিনি বলেন, তার দেশের আইন অনুযায়ী, অপরাধের সাথে যুক্ত হলে আশ্রয়প্রর্থীদের ফেরত পাঠানো সহজ৷
অবশ্য প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায়ও সফলতা দেখেছে ড্যানিশ সরকার৷ সরকারের তথ্য অনুযাযী, আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়া ৯৫ শতাংশ ব্যক্তিকেই এরমধ্যে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷
স্টকলোন্ড আরো জানান, নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ড্যানিশ সরকার৷ এরমধ্যে রয়েছে নিজ দেশে ফেরত যেতে আশ্রয়প্রার্থীদের অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্রদান৷ খবরে জানা গেছে, নিজ দেশে ফেরত যেতে আশ্রয়প্রার্থীদের ২৭ হাজার ইউরো পর্যন্ত প্রণোদনা দিচ্ছে ডেনমার্ক৷
তবে প্রণোদনা প্রদানের মতো এমন প্যাকেজ ব্রিটিশ সরকার হাতে নেবে কি না, তা স্পষ্ট নয়৷
সমালোচনার মুখে ব্রিটিশ মন্ত্রী
অবশ্য ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন পদক্ষেপে সমালোচনা করছে দেশটির অনেক রাজনৈতিক দল৷ এমনকি নিজ দল লেবার পার্টির অনেক সংসদ সদস্যও শাবানা মাহমুদের এমন পরিকল্পনার সমালোচনা করছেন৷
তাছাড়া বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোও বিষয়টিকে নেতিবাচক জায়গা থেকে বিবেচনা করছে৷ এই দলগুলো বলছে, ডানপন্থিদের বিশেষ করে রিফর্ম ইউকের চাপের মুখে এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে ব্রিটিশ সরকার৷
লেবার পার্টির সাংসদ ক্লিভ লিউস বিবিসিকে বলেন, অভিবাসন বিষয়ে ড্যানিশ সরকারের আইন বেশি শক্ত৷ ‘‘তারা এমন কিছু বিষয় হাতে নিয়েছে যাকে আমরা দক্ষিণপন্থি বলি,’’ জানান তিনি৷
ব্রিটেন কি ডেনমার্কের মতো আইন করতে পারবে?
সমালোচকদের অনেকে আবার বলছেন, ডেনমার্কের সাথে যুক্তরাজ্যের অনেক পার্থক্য রয়েছে৷ আর এ কারণে ড্যানিশ সরকারের আদলে আশ্রয়প্রার্থী বা শরণার্থী বিষয়ক আইনের প্রয়োগ কঠিন হতে পারে বলে মনে করেন তারা৷
যেমন জনসংখ্যার দিক থেকে দেশ দুটির পরিস্থিতি ভিন্ন রকমের৷ যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যা ডেনমার্কের চেয়ে ১১ গুণ বেশি৷
তাছাড়া ড্যানিশ সরকারের মতো ভাষা বিষয়ক কঠোর আইন ব্রিটেনে সরকারের জন্য যুতসই না-ও হতে পারে বলে মনে করেন তারা৷ কেননা বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ ইংরেজি ভাষায় কথা বলার দক্ষতা অর্জন করে থাকে, যা ড্যানিশ ভাষার বেলায় বাস্তবিক নয়৷ এ কারণে ইংরেজি ভাষার দক্ষতার মাপকাঠি যুক্ত করার বিষয়টি খুব বেশি ফল বয়ে না-ও আনতে পারে বলে করেন অনেকে৷
তাছাড়া ব্রিটেনের মতো ডেনমার্কে নৌকায় করে অভিবাসী আগমনের ঘটনাও খুব একটা ঘটে না৷
আর তাই পারিবারিক পুনর্মিলনের কঠোর আইন, ভাষাগত দক্ষতার মাপকাঠি বৃদ্ধি- এমন সব বিষয় হয়তো কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে, তবে তা নৌকায় করে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আগমনের উপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক৷