অ্যামাজনে ১ লাখ গাছ কেটে ‘জলবায়ু বাঁচাও’ যাত্রা শুরু
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৪০ এএম
চলতি বছরের ‘কপ৩০’ সম্মেলনকে ঘিরে শুরু থেকেই রয়েছে নানা বিতর্ক। এবারের সম্মেলনের আয়োজক দেশ ব্রাজিলকে নিয়ে সমালোচনা যেন থামছেই না। কেননা এদিকে পরিবেশ বাঁচানোর স্লোগান দিলেও অ্যামাজনের ১ লাখ গাছ কেটে সম্মেলনের যাত্রা শুরু করেছে ব্রাজিল। জানা গেছে, বিদেশি প্রতিনিধিদের আনাগোনা সহজ করতেই চার লেনের হাইওয়ে তৈরির সময় গাছগুলো কাটতে হয়েছে। একদিকে পরিবেশবাদী প্রচারণা অন্যদিকে বৃক্ষনিধনের মতো কাজ করার বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ। এপি, এএফপি।
অ্যামাজন জঙ্গল। যার আরেক নাম বিশ্বের ফুসফুস। স্থানীয় কাঠুরে, খনিজ সম্পদ ও খামারিদের লোভের শিকার প্রতিদিন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে পৃথিবীর এই শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্র! পেরু, কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা, গায়ানা, সুরিনাম, ইকুয়েডর, ফরাসি গায়ানার সীমান্ত ঘেঁষা বিরাট বনভূমির (৭৫ লাখ বর্গকিমি.) ৬০ শতাংশই ব্রাজিল ভূখণ্ডে। স্বভাবতই ক্ষয়ক্ষতিতে যেমন ব্রাজিলের দায় সর্বাধিক, রক্ষাণাবেক্ষণেও মাথাব্যাথাটা ব্রাজিলেরই বেশি। ঠিক এ লক্ষ্যেই এবার জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ৩০’ কেন্দ্র করে ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্ট (টিএফএফএফ) নামে ১২৫ বিলিয়ন ডলারের বন সংরক্ষণ তহবিল ঘোষণা করেছে ব্রাজিল সরকার। বিরাট এ তহবিলের মূল ভরসা দাতা দেশগুলো। ইতিমধ্যেই অনুদান দিয়েছে নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগালের মতো বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ। আশ্চর্যের বিষয় হলো- বন রক্ষার নামে হাত পাতছে বিশ্ব দরবারে অথচ সেই বন কেটেই তৈরি করেছে রাজকীয় সড়ক, এই নিয়েই সমালোচনার ঝড় উঠেছে দেশে দেশে।
বিশ্বজুড়ে পরিবেশবিদ, জলবায়ু কর্মী ও সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে বিশ্বনেতারা বন রক্ষার বার্তা দিতে এসেছেন সেখানে সেই বনই যদি কেটে ফেলা হয়- তবে সেটাই বা কেমন পরিবেশ নেতৃত্ব? নতুন নির্মিত এই মহাসড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩ কিলোমিটার (৮ মাইল)। এটি বেলেম শহরের মূল কেন্দ্র থেকে সম্মেলনস্থল পর্যন্ত সংযোগ তৈরি করেছে যেন ২০০টি দেশ থেকে আমন্ত্রিত প্রায় ৫০ হাজার অতিথি ও প্রতিনিধি সহজে যাতায়াত করতে পারেন। যদিও ব্রাজিল সরকার গাছার কাটার বিষয়ে ভিন্নমত দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, সড়কটি হবে ‘সবুজ ও টেকসই’। এতে সৌরচালিত এলইডি আলো, ৩০টির বেশি বন্যপ্রাণী পারাপার সেতু, সাইকেল লেন ও গাছের বেড়া থাকবে। কিন্তু পরিবেশবিদদের মতে, এটি কোনোভাবেই টেকসই উন্নয়ন নয়। কানাডিয়ান জলবায়ু কর্মী মাইক হুডেমা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, ‘আপনি জলবায়ুর নেতা হতে পারেন না, যদি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলবায়ু সমাধানকেই কেটে ফেলেন।’
একজন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন, ‘যদি তারা সত্যিই বিশ্বাস করতেন যে জলবায়ু পরিবর্তন এক ভয়ানক সংকট, তবে তারা পৃথিবীর ফুসফুস (অ্যামাজন বন) নিজেদের সুবিধার জন্য ধ্বংস করতেন না।’ নতুন এই হাইওয়ে প্রকল্পের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল প্রায় দশ বছর আগে ব্রাজিলের পারা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে। তখনই পরিবেশবিদরা এর বিরোধিতা করে বলেন, এটি অমাজনের বুকে নতুন ক্ষত তৈরি করবে। পরে প্রকল্পটি স্থগিত হয়ে যায়।
কিন্তু (কপ৩০) আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হতেই প্রকল্পটি হঠাৎ নতুন করে চালু হয়।
ব্রাজিলের পরিবেশ গবেষক লুইসা ফেরেইরা এ বিষয়ে বলেন, ‘এটি এক প্রকার ‘সবুজ ধোঁকাবাজি’। তিনি আরও বলেন, ‘যতই সৌর বাতি লাগান না কেন, বন কাটা মানেই পরিবেশ ধ্বংস। সম্মেলনের সাফল্য এখন এই বিরোধের মধ্যেই হারিয়ে যাচ্ছে।’ অ্যামাজন রেইনফরেস্টকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। এটি বিশ্বের মোট কার্বন ডাইঅক্সাইডের প্রায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ শোষণ করে রাখে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবৈধ বননিধন, কৃষি সম্প্রসারণ ও খনি প্রকল্পের কারণে এই অঞ্চল ভয়াবহ চাপে পড়েছে। বিজ্ঞানীরা বারবার সতর্ক করেছেন, যদি অমাজনের মোট বনাঞ্চলের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হারিয়ে যায়, তাহলে পুরো বনভূমি সাভানায় রূপ নেবে। এর ফলে বিলিয়ন টন কার্বন বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে আরও ত্বরান্বিত করবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও সামাজিক মাধ্যম ট্রুথে লিখেছেন, ‘তারা পরিবেশবাদীদের জন্য রাস্তা বানাতে গিয়ে অ্যামাজনকে ছিঁড়ে ফেলেছে। এটা এক ভয়ানক কেলেঙ্কারি!’ এছাড়াও ইউরোপ, কানাডা ও দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কয়েকটি পরিবেশ সংস্থা এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত বন সংরক্ষণ, বন ধ্বংস নয়।
উল্লেখ্য, এবারের ৩০তম জলবায়ু সম্মেলনটি ১০ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত চলবে। সম্মেলনে ফসিল জ্বালানি নির্ভরতা কমানো, বন সংরক্ষণে অর্থায়ন, জলবায়ু অর্থনীতি ও প্রযুক্তি সহায়তা এবং ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির অগ্রগতি পর্যালোচনা নিয়ে আলোচনা হবে।