Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিতে ব্রিটেন

Icon

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০১:১৫ পিএম

চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিতে ব্রিটেন

চীনের কাছ থেকে ধার নেয়ার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় এখন চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে  ব্রিটেন। এরই মধ্যে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারকে। শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিকরা উদ্বেগ জানিয়েছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে  ব্রিটেনের শত শত বিলিয়ন পাউন্ড ঋণ থাকা দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাদের আশঙ্কা, এই নির্ভরশীলতা চীনকে ব্রিটিশ রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিতে পারে। বিশেষ করে যখন সরকার অতিরিক্ত ব্যয় ও ঋণের সুদে জর্জরিত। এ খবর দিয়েছে লন্ডনের অনলাইন দ্য টেলিগ্রাফ।

এই সতর্কবার্তা এমন এক সময়ে দেয়া হয়েছে, যখন চীনের দুই সন্দেহভাজন গুপ্তচরের বিরুদ্ধে মামলা লেবার সরকার প্রত্যাহার করে নেয়ায় সমালোচনা উঠেছে। কারণ তারা বেইজিংকে ‘নিরাপত্তা হুমকি’ ঘোষণা করতে অস্বীকৃতি জানায়। সোমবার চীন বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে পার্লামেন্টে বিতর্ক বাধ্যতামূলক করার হুমকি দিয়েছে কনজারভেটিভরা। নিরাপত্তা বিষয়ক সাবেক মন্ত্রী টম টুগেনডাট বলেছেন, তিনি সরকারের বিরুদ্ধে বেইজিংয়ের কাছে নতি স্বীকার করার অভিযোগ তুলবেন। অপরদিকে এমপি অ্যালিসিয়া কেয়ার্নস জানতে চান, চীনকে হুমকি না বলার সিদ্ধান্ত কে নিয়েছিল।

লেবার সরকার প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছে, প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জোনাথন পাওয়েল এই গুপ্তচর মামলার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন। রোববার রাতে কনজারভেটিভ নেতা কেমি ব্যাডেনক এক চিঠিতে স্টারমারের কাছে স্পষ্টতা ও সততা দাবি করে লিখেছেন, আপনি এবং আপনার মন্ত্রীরা জাতীয় নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বেইজিংয়ের মুখোমুখি হতে ব্যর্থ হয়েছেন। এখন পর্যন্ত আপনার সরকার এই কেলেঙ্কারি নিয়ে চারটি ভিন্ন গল্প দিয়েছে, যা স্পষ্ট করে যে আপনি চীনকে তুষ্ট করতে গিয়ে  ব্রিটেনের নিরাপত্তা দুর্বল করেছেন।

উল্লেখ্য, বর্তমানে  ব্রিটেনের ৩ ট্রিলিয়ন পাউন্ডের জাতীয় ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেয়া। এর মধ্যে সার্বভৌম ঋণদাতারাও রয়েছে। তবে চীনের হাতে ঠিক কত ঋণ রয়েছে তা স্পষ্ট নয়। কারণ ট্রেজারি এ বিষয়ে কোনো প্রকাশ্য তথ্য দেয় না। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবে চীনের ঋণধারার হিসাব প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায় ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্যিক বিরোধের পর চীন আমেরিকান বন্ড বিক্রি করে ঋণ হ্রাস করেছে। দ্য টেলিগ্রাফ সম্প্রতি জানায়, ট্রেজারি এ বছর শুরুর দিকে বেইজিংয়ের গুপ্তচরবৃত্তি সংক্রান্ত এক সরকারি প্রতিবেদন প্রকাশ ঠেকাতে লবিং করে, যা চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

প্রখ্যাত বন্ড বিশ্লেষক এডওয়ার্ড ইয়ারডেনি ‘বন্ড ভিজিল্যান্টিস’ শব্দটি চালু করেন। তিনি সতর্ক করেছেন,  ব্রিটেনের বন্ড মালিকানা ব্যবহার করে চীন স্পষ্টভাবে জানাতে পারে যে তারা  ব্রিটেনের চীনবিষয়ক নীতিতে অসন্তুষ্ট। তিনি বলেন, চীন প্রায়শই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণ দিয়ে বন্দর, খনি বা কৌশলগত সম্পদে নিয়ন্ত্রণ নেয়ার অভিযোগের মুখে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে তিনি শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের কথা উল্লেখ করেন। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ওই বন্দর চীনের হাতে দীর্ঘমেয়াদে লিজে দিতে বাধ্য হয় শ্রীলঙ্কা। ইয়ারডেনি বলেন, যখন একটি দেশ আর্থিকভাবে দুর্বল ও অতিরিক্ত ব্যয়গ্রস্ত হয়, তখন সেটি সহজেই প্রভাবিত হতে পারে। 

লেবার সরকারের ‘গ্রোথ মিশন’ নীতির অংশ হিসেবে অর্থমন্ত্রী র‌্যাচেল রিভস চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণে উদ্যোগী হন। কনজারভেটিভ আমলে বিনিয়োগ কমে গেলেও, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ  ব্রিটেনে চীনা প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ছিল ৩.৭ বিলিয়ন পাউন্ড, যা এখন পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। কিন্তু চীনের সাম্প্রতিক ঘোষণা, যে কোনো দেশ চীনা খনিজ বা ব্যাটারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করতে চাইলে বেইজিংয়ের অনুমতি নিতে হবে। তাদের এ ঘোষণা  ব্রিটেনের জন্য নতুন উদ্বেগের কারণ হয়েছে। ইন্টার-পার্লামেন্টারি অ্যালায়েন্স অন চায়নার প্রধান লিউক ডি পুলফোর্ড বলেন, এটি স্পষ্ট সংকেত যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এখন অন্যান্য দেশের নির্ভরশীলতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়।

এমপি অ্যালিসিয়া কেয়ার্নস আরও বলেন, আমরা যদি এখনই সতর্ক না হই, তবে চীনের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ব এবং চীনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই চলতে হবে আমাদেরকে। ব্রিটেনের ঋণের সুদের হার সম্প্রতি ২৭ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে, যা সরকারের বাজেট ভারসাম্য রক্ষায় বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ২০১৯ সালে ইউবিএস ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ পল ডোনোভান চীনের ‘শূকর জ্বর’ নিয়ে মন্তব্য করায় তাকে বরখাস্ত করা হয়। এ থেকে দেখা যায় যে, ব্রিটিশ আর্থিক খাত এখন চীনকে সমালোচনা করতে ভয় পায়। ব্রিটিশ একজন শীর্ষ অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকারের বর্তমান আর্থিক দুর্বলতা এমন পর্যায়ে যে তারা অর্থনৈতিক স্থিতি নষ্ট হওয়ার ভয়ে শত্রুভাবাপন্ন বিদেশি শক্তির প্রতিও নমনীয় হয়ে উঠেছে।

চীনা কোম্পানি মিং ইয়াং সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, তারা স্কটল্যান্ডে ১.৫ বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে  ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় উইন্ড টারবাইন কারখানা নির্মাণ করবে। এটি জ্বালানি মন্ত্রী এড মিলিব্যান্ডের জন্য বড় সাফল্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আগে সতর্ক করেছিল, চীনা সংস্থাগুলোর তৈরি উইন্ড ফার্মগুলো গুপ্তচরবৃত্তির জন্য ব্যবহার হতে পারে এবং এর আড়ালে চীনা প্রকৌশলীদের  ব্রিটেনে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হতে পারে। দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে চীনা বিনিয়োগকারীরা  ব্রিটেনের বৃহত্তম পাবলিক কোম্পানিগুলোতে প্রায় ৯০ বিলিয়ন  পাউন্ড বিনিয়োগ করেছে। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সার্বভৌম তহবিলের মালিকানায় এখন বিএই সিস্টেমস, রোলস-রয়সে ও ব্যাবককের মতো প্রতিরক্ষা খাতের সংস্থার উল্লেখযোগ্য শেয়ার রয়েছে।

ওদিকে গুপ্তচরবৃত্তির মামলা প্রত্যাহারের ঘটনায় ট্রেজারির ভূমিকা নিয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, জোনাথন পাওয়েল ও ট্রেজারি যৌথভাবে এই মামলা চীনকে তুষ্ট করতে বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাতে বেইজিং ভবিষ্যতে বিনিয়োগ বন্ধ না করে। অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসন এই ঘটনা নিয়ে  ব্রিটেনকে তীব্র সমালোচনা করেছে। এমনকি হোয়াইট হাউস সতর্ক করেছে, লন্ডনে পরিকল্পিত চীনা সুপার-এম্বাসি নির্মাণের অনুমতি না দিতে বলেছে। সরকার এ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেনি। তবে ২১ অক্টোবরের সময়সীমা আবারও পিছিয়ে দেয়ার কথা ভাবছে। কারণ নিরাপত্তা উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার