মধ্যপ্রাচ্যে বুশের মতোই ভুল করলেন ট্রাম্প

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ০৮:৪০ পিএম

দুই দশক আগের কথা। আত্মবিশ্বাস আর আগ্রাসনের বিষাক্ত মিশ্রণে ইরাকের বুকে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। সে সময় বলা হয়েছিল, এটি হবে একটি ‘ঝটিকা অভিযান’।
কয়েক দিনের মধ্যে মিশন সম্পন্ন হবে, প্রতিষ্ঠা হবে গণতন্ত্র। কিন্তু বাস্তবে জন্ম নিয়েছিল এক অন্তহীন যুদ্ধ। যা গ্রাস করে নিয়েছিল লাখো মানুষের প্রাণ। ভেঙে পড়েছিল গোটা অঞ্চল। আবার সেই একই পথে চলতে শুরু করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
একইরকম আত্মবিশ্বাস, একইরকম আগ্রাসী কূটনীতি এবং একইরকম অন্ধত্ব-পালটেছে শুধু অভিনেতা। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের পাশে দাঁড়িয়ে যে সামরিক পদক্ষেপ ট্রাম্প নিয়েছেন, তা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকেই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যকেই আবারও ঠেলে দিচ্ছে এক অস্থির, রক্তাক্ত ভবিষ্যতের দিকে।
অথচ বুশের সেই যুদ্ধকে ‘একটি ভয়াবহ ভুল’ বলে অভিহিত করেছিলেন ট্রাম্প নিজেই। আজ সেই ভুল পথটাকেই আবার বেছে নিলেন তিনি। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।
২০১৬ সালে ট্রাম্প নির্বাচনি প্রচারে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধগুলো ছিল ভয়াবহ ভুল।’ ২০২০ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনি সমাবেশেও তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাবে এবং বিদেশ নয়, নিজের ঘর সংস্কারে মন দেবে।’
অথচ এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে নিচ্ছেন ইরান-ইসরাইল সংঘাতের মাঝে।
বিশ্লেষকদের মতে, এর ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের কূটনৈতিক অগ্রগতি যেমন ব্যর্থ হতে পারে, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত শুরু হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যেটার খেসারত দিতে হবে মার্কিনিদেরও।
এই পরিস্থিতিতে একযোগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দুই ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের দুই বিশিষ্ট বিশ্লেষক প্রগতিশীল ম্যাথিউ ডাস এবং রক্ষণশীল সম্পাদক সোহরাব আহমারি।
তারা স্পষ্ট করে বলেছেন, যুদ্ধ নয়, এই মুহূর্তে কূটনীতি ও শান্তি আলোচনার পথই গ্রহণ করা উচিত। তারা একে শুধুই রাজনৈতিক ভুল নয়, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলেও আখ্যা দিয়েছেন। এই যুদ্ধকে ঘিরে জনমতও ট্রাম্পের বিপক্ষেই।
সাম্প্রতিক একটি জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ১৬ শতাংশ আমেরিকান এই যুদ্ধকে সমর্থন করেন। অপরদিকে ৬০ শতাংশ এর সরাসরি বিরোধিতা করেছেন। এমনকি রিপাবলিকান ভোটারদের মধ্যেও অর্ধেকের বেশি চান যেন যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে জড়িত না হয়।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যুদ্ধবিরোধী এই অবস্থান শুধু প্রগতিশীল দলেই সীমাবদ্ধ নয়। বার্নি স্যান্ডার্স, আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজদের পাশাপাশি ট্রাম্পের নিজের সমর্থকরাই যেমন, জোশ হাওলি, মার্জোরি টেলর গ্রিন, টাকার কার্লসন, স্টিভ ব্যানন এবং চার্লি কার্ক স্পষ্টভাবে এর বিরোধিতা করেছেন।
পেন্টাগনের কিছু কট্টরপন্থি কর্মকর্তা বলেছেন, ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালিয়েই তারা ‘এক ধাক্কায়’ ইরানকে দমন করতে পারবেন।
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ভ্রান্ত ধারণা। এই স্থাপনাটি পাহাড়ের নিচে অবস্থিত এবং এর ধ্বংস কতটা হয়েছে তা নিরূপণ করা হবে অসম্ভব। যতক্ষণ না সেখানে সরাসরি পরিদর্শন করা হয়। অন্যদিকে, নিশ্চুপ থাকবে না ইরানও। তারা হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে। যেটি দিয়ে বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ তেল সরবরাহ হয়।
এছাড়া, তারা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য ঘাঁটিগুলোর ওপর পালটা হামলা চালাতে পারে বলেই ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। আর যুক্তরাষ্ট্র তখন জবাব দেবে। এই প্রতিক্রিয়া ও পালটাপালটি আঘাতের ফলে শুরু হবে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ।
২০০৩ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরাকে হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস এবং শাসক পরিবর্তন। লাখো প্রাণহানি, শরণার্থী সংকট ও গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভঙ্গুরতা ছিল এর পরিণতি।
যুদ্ধের প্রকৃত প্রেক্ষাপট, তথ্যপ্রমাণ ও কূটনৈতিক বিকল্প উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র একটি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। যা আজও বিশ্ব রাজনীতির এক কালো অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত।