
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে সামরিক হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে দুই সপ্তাহের সময় নিয়েছেন। এর মাধ্যমে মূলত গত সপ্তাহে ইসরাইল ইরানে হামলা শুরু করার পর স্থবির হয়ে পড়া আলোচনাগুলো পুনরায় শুরু করার জন্য এক জরুরি কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।
ট্রাম্প ও তার উপদেষ্টারা আশা করছেন, একদিকে ইসরাইলের ক্রমাগত হামলা, অন্যদিকে ক্ষেপণাস্ত্র মজুদে বড় ক্ষতির মুখে পড়ায় ইরান তাদের আগের কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে এমন কিছু শর্তে রাজি হবে, যেগুলো তারা এর আগে প্রত্যাখ্যান করেছিল।এর মধ্যে রয়েছে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম পুরোপুরি পরিত্যাগ করা।
গত কয়েকদিন ধরে ট্রাম্প যে ধরনের যুদ্ধংদেহী ভাষায় কথা বলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল তিনি যেকোনো সময় হামলার নির্দেশ দেবেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিলেন।আর এতে করে আরও সময় পাওয়া যাচ্ছে সম্ভাব্য বিপর্যয়কর পরিণতি বিবেচনা করার—বিশেষত এমন এক যুদ্ধের সম্ভাবনা, যা ট্রাম্প নিজেই এড়িয়ে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবে এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কূটনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা সহজ হবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সপ্তাহের শুরুতেই অবশ্য হোয়াইট হাউসে এক আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফ ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প আশঙ্কা করতে থাকেন, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা হয়তো সত্যিই সফল হয়ে যেতে পারে। যার ফলে এই পরিকল্পনা আর এগোয়নি।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) পর্যন্ত ভ্যান্স ও উইটকফ দুজনই ওয়াশিংটনেই অবস্থান করছিলেন।
এদিকে শুক্রবার জেনেভায় ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরানি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক কথা রয়েছে। এ উপলক্ষ্যে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি ইতোমধ্যেই জেনেভায় পৌঁছেছেন। ইরান-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় উইটকফ যে সর্বশেষ প্রস্তাব ইরানকে দিয়েছিলেন, এ বৈঠকে সেটির বিস্তারিত ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের জানানো হয়েছে।
ইসরাইলি হামলা শুরুর আগে ইরান অবশ্য সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। মার্কিন এক কর্মকর্তার মতে, শুক্রবারের জেনেভা বৈঠক থেকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির আশা কম। তবে হোয়াইট হাউস বলছে, কূটনীতির পথ বন্ধ নয়।
হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা বলেন, “এটি ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে ইরানের বৈঠক। প্রেসিডেন্ট আমাদের মিত্রদের যে কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগকে স্বাগত জানান, যা ইরানকে তার চুক্তির কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে।”
ইসরাইলি হামলা শুরুর পর থেকে ইরান বারবার জানিয়ে দিয়েছে যে, এই আগ্রাসন বন্ধ না হলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে কোনো আলোচনায় বসবে না। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি জেনেভায় পৌঁছেও সেই কথা পুনর্ব্যক্ত করলেন।
এদিকে এখনো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে হামলা বন্ধ করতে চাপ দেয়নি। বরং ট্রাম্প এ সপ্তাহেই জানিয়েছেন, তিনি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে বলেছেন “এগিয়ে যেতে”।
অন্যদিকে ইরান এখনো পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের প্রশ্নে কোনো নমনীয়তা দেখায়নি—তারা এটিকে ‘রেড লাইন’ হিসেবে দেখে। আর এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে ভবিষ্যতে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনার সূচিও নেই বলে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্বিত করে ট্রাম্প যেন কূটনৈতিক পথেই এখন ভরসা রাখছেন—যদিও একদিন আগেই তিনি এমন সম্ভাবনাকে প্রায় অস্বীকার করেছিলেন।
হোয়াইট হাউস প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বৃহস্পতিবার বলেন, “প্রেসিডেন্ট সবসময় কূটনীতিক পথ খোলা রাখতে চান, তবে বিশ্বাস করুন, প্রয়োজন হলে তিনি শক্তি প্রয়োগে ভয় পান না। আর ইরানসহ গোটা বিশ্ব জানে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রাণঘাতী বাহিনী।”
এদিকে জানা গেছে, এ সপ্তাহেই একাধিক ‘সিচুয়েশন রুম’ বৈঠকে ট্রাম্প উপদেষ্টাদের জিজ্ঞাসা করেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাঙ্কার-ধ্বংসকারী বোমা দিয়ে ইরানের ফরদো পারমাণবিক কেন্দ্র পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব কি না এবং তেমন একটি অভিযানে কত সময় লাগবে।
তিনি বারবার বলেছেন, তিনি এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে চান না যা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে গড়াতে পারে। এমনকি তার ঘনিষ্ঠ অনুগামী স্টিভ ব্যানন সেই আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। বৃহস্পতিবার একসঙ্গেই মধ্যাহ্নভোজ সারেন দুজনে।
যদিও ট্রাম্প সামরিক বিকল্পগুলোর সঙ্গে পরিচিত, তবে তিনি দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের ঝুঁকি নিয়েও উদ্বিগ্ন।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কোনো হামলার পর দীর্ঘমেয়াদে জড়িত থাকার সম্ভাবনা শুধু ভবিষ্যদ্বাণিমূলক বিশ্লেষণ—সুনিশ্চিত নয়।
মূলত এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণেই দু সপ্তাহের সময় নিয়েছেন ট্রাম্প। এই ‘দুই সপ্তাহের সময়’ অবশ্য সব মহলে ইতিবাচক সাড়া পায়নি। এক ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “এটা আমাদের কোনোভাবেই সাহায্য করছে না।”
জানা গেছে, ট্রাম্প এ সময়ের আগেই নিজ প্রোপার্টি নিউ জার্সি থেকে ফিরে হোয়াইট হাউসে উচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দা ব্রিফিংয়ে অংশ নেবেন।
এক্ষেত্রে সিআইএ পরিচালক জন র্যাটক্লিফ ও জয়েন্ট চিপস চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কেইনের ওপর সবচেয়ে বেশি ভরসা করছেন ট্রাম্প।
আর এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কেন্দ্রে রয়েছেন স্টিভ উইটকফ—প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশ্বস্ত বন্ধু ও মধ্যপ্রা বিষয়কচ্য দূত। তিনি এ মাসের শুরুতেই ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে সরাসরি বার্তা চালাচালি শুরু করেন এবং সাম্প্রতিক উত্তেজনার মধ্যেও কিছু যোগাযোগ রক্ষা হয়েছে বলে জানান।
উইটকফ যুদ্ধের আগে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাতে ইরানকে ধাপে ধাপে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পুরোপুরি বন্ধ করতে হতো। বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউস বলেছে, এই শর্ত এখনো চূড়ান্ত চুক্তির জন্য অপরিহার্য।
ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের মতে, তারা শুক্রবারের বৈঠকে বুঝতে চাইবেন—ইরান এখন কতটা সংলাপে আগ্রহী। কারণ, তারা বিশ্বাস করেন—উভয়পক্ষের সামরিক হামলা সমস্যার সমাধান নয়।
এদিকে ইসরাইলি হামলার মধ্যেও ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প অটুট রয়েছে এবং সম্ভবত গোপনে কিছু কর্মসূচিও চালু রয়েছে—যা কেবল হামলা চালিয়েই ধ্বংস করা যাবে না।
অন্যদিকে, ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের বাইরে থাকা বেশিরভাগ মার্কিন কূটনীতিকদের এ মুহূর্তে কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়নি—যা মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ট্রাম্পের সঙ্গেই কানাডার জি-৭ সম্মেলন থেকে আগেভাগে ওয়াশিংটনে ফিরে এসেছেন।
গত রোববার তিনি ফ্রান্স, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় বলেন, “আমরা এমন এক কূটনৈতিক পথ খুঁজছি যা নিশ্চিত করে ইরান কখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারবে না।”
পরে বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামির সঙ্গে বৈঠকে রুবিও বলেন, “ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারবে না—এ বিষয়ে আমরা একমত।”
ল্যামি এক বিবৃতিতে বলেন, “আজ হোয়াইট হাউসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিও এবং মধ্যপ্রাচ্য দূত উইটকফের সঙ্গে বৈঠকে আমরা আলোচনা করেছি—ইরানকে অবশ্যই একটি চুক্তি করতে হবে, তা না হলে সংঘাত আরও গভীর হবে। এখন আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কূটনৈতিক সমাধানের জানালা খোলা আছে।”
এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও আঞ্চলিক বিভিন্ন পক্ষ ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র ইতোমধ্যেই মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে।
সূত্রমতে, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পাঠানো বার্তাগুলোর জবাব দিলেও ইরানের অবস্থান এখনো অপরিবর্তিত।
(সিএনএনের প্রতিবেদন অবলম্বনে)