বিশ্ব কী এখন পরমাণু বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে?

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৫, ০৯:২২ পিএম

ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর ওপর চালানো সামরিক হামলা বৈশ্বিকভাবে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পাশাপাশি পারমাণবিক দূষণ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরাও এখন এ ঘটনার দিকে গভীর নজর দিচ্ছেন।
সোমবার (১৬ জুন) জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি সতর্ক করে বলেন, ইসরাইলি হামলায় ইরানের নেতানজে পারমাণবিক স্থাপনাটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তেজস্ক্রিয় ও রাসায়নিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরী হয়েছে।
ভয়াবহ এক নতুন অধ্যায়
দখলদার ইসরাইল গত ১৩ জুন ভোররাত থেকে ইরানে ধারাবাহিক বিমান হামলা শুরু করে। তাদের হামলার মূল লক্ষ্য ছিল নেতানজে ও ইসফাহানে অবস্থিত ইরানের মূল পরমাণু কেন্দ্রগুলো। ইসরাইলের এ হামলা এমন এক সময় সংঘটিত হলো, যখন ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে পরমাণু আলোচনার অগ্রগতি হচ্ছিল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান কাজা ক্যালাস শনিবার (১৪ জুন) এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এই সংঘাত গভীর উদ্বেগজনক’।
তিনি জানান, ইইউ ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের বিরুদ্ধে হলেও এর সমাধান কূটনৈতিক পথেই হওয়া উচিত — সামরিক পথে নয়।
অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘এ হামলায় আমেরিকা জড়িত নয়’। এর পরেই তিনি আবার বলেন, ‘ইরানকে পরমাণু অস্ত্র অর্জন করতে দেওয়া হবে না’।
ইরান বরাবরের মতোই দাবি করে আসেছে যে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং বেসামরিক উদ্দেশ্যে।
কী বলছে আইএইএ
এদিকে ভিয়েনায় জরুরি এক বৈঠকে আইএইএ মহাপরিচালক গ্রোসি জানান, নেতানজে ও ইসফাহান কেন্দ্রের বাইরে এখনো পর্যন্ত তেজস্ক্রিয়তা স্বাভাবিক সীমার মধ্যেই আছে। তবে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘যে কোনো সামরিক সংঘাত তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ায়’।
গ্রোসি বলেন, নেতানজের ভূ-উপরিস্থ স্থাপনাটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে। যদিও মাটির নিচের সেন্ট্রিফিউজ ইউনিট অক্ষত আছে। তবে পাওয়ার লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সেখানে ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইড গ্যাসভর্তি সেন্ট্রিফিউজগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এই গ্যাস অতি সংবেদনশীল, দাহ্য এবং শ্বাস নিলে প্রাণঘাতী হতে পারে। এখনো নিশ্চিত নয় যে, এই গ্যাস লিক হয়েছে কি না, শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
আইএইএ প্রধান বলেন, ‘আমাদের যদি যথাসময়ে কারিগরি তথ্য না দেওয়া হয়, তাহলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর প্রকৃত ঝুঁকি নিরূপণ কিংবা জনগণকে সঠিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের থাকবে না’।
আগে কখনো পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা হয়েছিল?
পৃথিবীর ইতিহাসে কার্যক্রম চলমান থাকা পরমাণু স্থাপনায় হামলার ঘটনা বিরল। তবে নির্মাণাধীন অবস্থায় বেশ কয়েকবার বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা হয়েছে। যেমন-
• ১৯৮০: ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরানের ‘অপারেশন স্কর্চ সোর্ড’ ইরাকের অসমাপ্ত ওসিরাক চুল্লিতে হামলা চালায়।
• ১৯৮১: ইসরাইল ‘অপারেশন অপেরা’ চালিয়ে ফ্রান্স নির্মিত সেই চুল্লি ধ্বংস করে দেয়।
• ১৯৯১: মার্কিন ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ ইরাকের তুয়াইথা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালায়।
• ২০০৭: ইসরাইল সিরিয়ায় উত্তর কোরিয়ার সহায়তায় নির্মাণাধীন চুল্লি ধ্বংস করে ‘অপারেশন আউটসাইড দ্য বক্স’ অভিযান চালিয়ে।
অপরদিকে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বেসামরিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও হামলার নজির আছে। যেমন-
• স্পেনে বাস্ক বিচ্ছিন্নতাবাদীরা লেমোয়িজ পরমাণু কেন্দ্রে ১৯৭৮-৭৯ সালে দুইবার বোমা হামলা চালায়।
• ১৯৮২ সালে ফ্রান্সে পারমাণবিক বিরোধীরা পাঁচটি আরপিজি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে নির্মাণাধীন ক্রেই-ম্যালভিল প্লান্টে হামলা করে।
• একই বছর এএনসি দক্ষিণ আফ্রিকায় কেপটাউনের কুবার্গ পারমাণবিক কেন্দ্রে চারটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।
আগে কখনো পরমাণু বিপর্যয়ের এতটা কাছাকাছি পৌঁছেছিল?
বিশ্ব এর আগে একাধিকবার পরমাণু বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। যদিও কোনোবারই বিপর্যয় ঘটেনি। যেমন-
• ১৯৮৩: ‘পেট্রোভ ইন্সিডেন্ট’ নামে পরিচিত এক ঘটনায় সোভিয়েত কর্মকর্তারা ভুল করে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রের আগমন ভেবে প্রতিক্রিয়া দিতে যাচ্ছিলেন। তবে স্ট্যানিস্লাভ পেট্রোভ নামের এক অফিসার সজাগ থেকে তা থামিয়ে দেন।
• ২০২৫ মে: ভারত-পাকিস্তান সামরিক উত্তেজনার সময় ভারত তার ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে, যা পরে বেসামরিক ছিল বলে প্রমাণিত হয়। তবে উভয় পক্ষই পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ায় এটি ছিল এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি।
এসব বিষয়ে বিশ্লেষক ড্যান স্মিথ বলেন, ‘আমরা সবচেয়ে বেশি ভয় পাই, যখন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কমান্ডে কেউ সময়ের চাপে, উত্তেজনার আবহে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে’।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও পারমাণবিক উদ্বেগ
এদিকে রাশিয়া ২০২২ সালের মার্চে ইউক্রেনের জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক কেন্দ্র দখলে নেয়। সেখানে ট্যাংক ও গোলাবারুদ নিয়ে সেনা মোতায়েন করে এবং পাশের শহর নিকোপোল লক্ষ্য করে হামলা চালায়। যাতে ইউক্রেন পাল্টা গুলি চালাতে সাহস না পায়।
৬ মাসের মাথায় আগস্টে ইউক্রেন জানায়, রাশিয়ার হামলায় সেখানে হাইড্রোজেন লিক এবং তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়। পরে আইএইএ হস্তক্ষেপ করে সব চুল্লি বন্ধ করায় এবং যুদ্ধ সাময়িকভাবে থেমে যায়।
বিশ্ব কী এখন তেজস্ক্রিয় বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে?
ইরানে ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলা শুধু একটি দেশের বিরুদ্ধে নয়, এটি একটি বৈশ্বিক পরমাণু নিরাপত্তার শৃঙ্খলকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। তেহরান ও তেলআবিবের এই সংঘাত, তার ওপর ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা ও ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ – সব মিলিয়ে পৃথিবী যেন এক অনির্দিষ্ট, অশান্ত পরমাণু যুগে প্রবেশ করেছে।
(আল-জাজিরার প্রতিবেদন অবলম্বনে)