পর্দার ওপারের মানুষটির নির্দেশনায় যখন এপাশের মানুষটি নিজেকে সাজান, তখন কেবল চরিত্র নয়, তৈরি হয় এক অদৃশ্য রসায়নও। গ্ল্যামার জগতের ইতিহাসে লেন্সের এপার আর ওপারের এই মেলবন্ধন নতুন কিছু নয়। হলিউড থেকে বলিউড কিংবা দক্ষিণী সিনেমা—বারবার দেখা গেছে নায়িকারা সহ-অভিনেতার চেয়ে পরিচালকের প্রেমে বেশি মজেছেন। ‘বাহুবলি’ খ্যাত রম্যা কৃষ্ণা জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন পরিচালক কৃষ্ণা ভামসিকে, অভিনেত্রী খুশবু মালা পরিয়েছেন পরিচালক সুন্দর সির গলায়, আবার হাল আমলের ইয়ামি গৌতম বিয়ে করেছেন ‘উরি’ খ্যাত পরিচালক আদিত্য ধরকে। এই তালিকা দীর্ঘ।
সম্প্রতি দক্ষিণী সুন্দরী সামান্থা রুথ প্রভু ও ‘ফ্যামিলি ম্যান’ খ্যাত পরিচালক রাজ নিদিমোরুর বিয়ে এই চিরন্তন প্রশ্নটিকে আবারও আলোচনার টেবিলে নিয়ে এসেছে—নায়িকা-পরিচালক কেন প্রেমে পড়েন? শুটিং সেটের ‘অ্যাকশন’ আর ‘কাট’-এর মাঝখানের এই মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ করেছেন শোবিজ সংশ্লিষ্টরা এবং বিজ্ঞানীরা।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দক্ষিণী সিনেমার পরিচালক অশোক তেজার ব্যাখ্যাটি বেশ প্রণিধানযোগ্য। সম্প্রতি তামান্না ভাটিয়াকে নিয়ে ‘ওডেলা টু’ নির্মাণ করা এই নির্মাতা মনে করেন, একটি সিনেমা তৈরির দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় পরিচালক ও অভিনেত্রীর মধ্যে যে মানসিক সংযোগ তৈরি হয়, তা প্রেম বা বিয়ের জন্য উর্বর ক্ষেত্র। শুটিং সেটে প্রেমের সূচনা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ, পরিচালক আর অভিনয়শিল্পীরা প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। চরিত্রের গভীরতা, লুক, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ—সবকিছু নিয়ে তাদের প্রতিনিয়ত আলোচনা করতে হয়। এই পেশাগত ঘনিষ্ঠতা একসময় অজান্তেই ব্যক্তিগত আবেগে রূপ নেয়।
তেজার মতে, এই সম্পর্ক হুট করে তৈরি হয় না। প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর একে অপরের পছন্দ-অপছন্দ শেয়ার করা এবং সবশেষে একে অপরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়া। সময়ের সঙ্গে তারা আবিষ্কার করেন যে তারা পরস্পরের জন্য উপযুক্ত। তেলেগু বা বলিউড—উভয় ক্ষেত্রেই এমন বহু ঘটনা ঘটেছে। পরিচালকদের পাশাপাশি সহ-অভিনেতাদের সঙ্গেও নায়িকাদের প্রেমের নজির কম নয়। যেমন—রাশমিকা মান্দানা ও বিজয় দেবরকোন্ডার গোপন বাগদান ও ২০২৬ সালে বিয়ের গুঞ্জন এখন তুঙ্গে। এ প্রসঙ্গে নির্মাতাদের মত হলো, ইন্ডাস্ট্রির বাইরের কারও পক্ষে একজন তারকার শিডিউল বা কাজের চাপ বোঝা কঠিন। তাই একজন অভিনেত্রী যখন অভিনেতাকে বা পরিচালককে বিয়ে করেন, তখন সেই পারস্পরিক বোঝাপড়াটা সহজ হয়। অন-স্ক্রিন কেমিস্ট্রি তখন বাস্তবেও ছড়িয়ে পড়ে।
তবে এই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বাইরেও রয়েছে প্রেমের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। নায়িকা বা পরিচালক—দিনশেষে সবাই রক্ত-মাংসের মানুষ। আর এই মানুষের প্রেমে পড়ার পেছনে কাজ করে নির্দিষ্ট কিছু হরমোন ও রাসায়নিক বিক্রিয়া। মার্কিন নৃবিজ্ঞানী হেলেন ফিশার মানুষের প্রেমে পড়ার কারণকে তিনটি প্রধান স্তরে ভাগ করেছেন, যা শোবিজ তারকাদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
নৃবিজ্ঞানীর মতে, প্রেমের প্রথম স্তরটি কামপ্রবৃত্তি বা আকর্ষণের প্রাথমিক পর্যায়, যা মূলত টেস্টোস্টেরন ও ইস্ট্রোজেন হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এরপর আসে তীব্র আকর্ষণের স্তর। এই সময়ে মস্তিষ্কে ডোপামিন, অ্যাড্রিনালিন ও নরএপিনেফ্রিন হরমোনের নিঃসরণ ঘটে। শুটিং সেটের উত্তেজনা, নতুন কিছু সৃষ্টির আনন্দ—এসবই ডোপামিন ক্ষরণে সহায়তা করে। অনেকটা মাদকাসক্তির মতো এই অনুভূতিতে প্রিয় মানুষকে দেখলে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, যা মূলত অ্যাড্রিনালিনের কাজ। আর সর্বশেষ স্তরে কাজ করে অক্সিটোসিন হরমোন। এর প্রভাবেই মানুষ একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বা সংসারের স্বপ্ন দেখে।
একটি সিনেমার সেটে মাসের পর মাস একসঙ্গে থাকা, সৃজনশীল আলোচনার মাধ্যমে একে অপরকে চেনা এবং আবেগের আদান-প্রদান—এসব কিছুই হেলেন ফিশারের এই তিন স্তরের মধ্য দিয়ে একজন নায়িকাকে পরিচালকের দিকে ধাবিত করে। সামান্থা ও রাজের বিয়ে সেই বৈজ্ঞানিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ারই এক সুন্দর পরিসমাপ্তি মাত্র।