Logo
Logo
×

অর্থনীতি

চুরি-চোরাচালান দিয়ে চলছে দেশের স্বর্ণের বাজার

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:৫১ এএম

চুরি-চোরাচালান দিয়ে চলছে দেশের স্বর্ণের বাজার

বর্তমানে স্বর্ণের দাম প্রায় নিয়মিত বাড়ছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে জুয়েলারি দোকানের সংখ্যা। দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য বাণিজ্যিকভাবে স্বর্ণ আমদানি করা হয় না। তাই চাহিদার বড় অংশ পূরণ হয় যাত্রীর ব্যাগেজ বিধিমালা মেনে আনা স্বর্ণ দিয়ে।

পাশাপাশি, পুরোনো অলঙ্কারও কিছু চাহিদা মেটায়। তবে অনেক জুয়েলারি দোকানকে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও চোরাচালানের স্বর্ণের ওপর নির্ভর করতে হয়।

চুরি-ডাকাতি হওয়া অনেক স্বর্ণালঙ্কার ঢাকার তাঁতীবাজার, সাভার বাজারসহ কয়েকটি এলাকায় বিক্রি হয়। এই অলঙ্কারগুলো গলিয়ে নতুনভাবে তৈরি করা হয় বা স্বর্ণের পানি দিয়ে ধুয়ে বিক্রি করা হয়।

ঢাকা কাস্টমস হাউজের তথ্য অনুযায়ী, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ২০২২ সালে ৩৫ দশমিক ৭৩৩ টন এবং ২০২৩ সালে ৩১ দশমিক ৪৬৮ টন স্বর্ণের বার ব্যাগেজ রুলের আওতায় আমদানি হয়েছে। ২০২৪ সালেও একই ধারা বজায় ছিল।

ঢাকা কাস্টমস হাউজের কমিশনার মশিউর রহমান জানান, গত এক বছরে কোনো স্বর্ণ আমদানি হয়নি। এখন একজন যাত্রী বছরে একবার ১১৭ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণের বার ৫০ হাজার টাকা শুল্ক দিয়ে আনতে পারেন। অলঙ্কার হিসেবে বছরে একবার ১০ ভরি (১০০ গ্রাম) স্বর্ণ শুল্ক ছাড়া আনা যায়।

তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে চোরাচালানের আশঙ্কা বেড়েছে। তাই গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে এবং মাঝে মাঝে চোরাচালানের স্বর্ণ ধরাও পড়ছে।

স্বর্ণের ব্যবসায় স্বচ্ছতা আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালে স্বর্ণ নীতিমালা করে। পরের বছর বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ব্যাংকসহ ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিকভাবে স্বর্ণ আমদানির লাইসেন্স দেয়। পরে আরও একটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পায়। শুরুতে কিছু প্রতিষ্ঠান স্বর্ণ আমদানি করলেও ডলার সংকট, অনুমতি পেতে সময়ক্ষেপণ এবং ভ্যাটের কারণে ব্যবসায়ীরা আমদানিতে আগ্রহ হারান।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের ব্যাগেজ বিধিমালার আওতায় স্বর্ণ আনার সুযোগ কমিয়ে অর্ধেক করা হয় (২৩৪ গ্রাম থেকে ১১৭ গ্রাম)। একই সঙ্গে, ভরিপ্রতি শুল্ক দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে চার হাজার টাকা করা হয়।

এদিকে, বাংলাদেশ জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) তথ্য মতে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম আট মাসে ঢাকাসহ সারা দেশে ১৭টি প্রতিষ্ঠানে চুরি ও ডাকাতি হয়েছে, যাতে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। গত সাড়ে দশ মাসে এমন ১৮টি ঘটনা ঘটেছে।

বাজুস সভাপতি এনামুল হক দোলন জানান, ব্যাগেজ রুলের মাধ্যমে প্রতিদিন ১০-১২ হাজার ভরি স্বর্ণ দেশে আসে। চুরি-ডাকাতির স্বর্ণালঙ্কার কারা কেনে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জুয়েলারি ব্যবসায় কিছু অসাধু লোক থাকতে পারে যারা এগুলো কেনে। আবার ছদ্মবেশী ব্যবসায়ীও থাকতে পারে যারা লাইসেন্স নিয়ে ওই স্বর্ণ কেনে।

তার দাবি, কিছু স্বর্ণ পাশের দেশে পাচার হয়। দাম বাড়ার কারণে এক বছরে স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি ৬০ শতাংশ কমে গেছে বলে তিনি জানান।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সারাদেশে ১৮টি সোনার দোকানে চুরি-ডাকাতি হয়েছে। ডিসেম্বরের শুরুতে এক ব্যবসায়ী খুন হন।

চুরি-ডাকাতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা

গত ৩ জানুয়ারি ক্রাউন ডায়মন্ড অ্যান্ড জুয়েলার্স থেকে ১৫৯ ভরি স্বর্ণের অলঙ্কার, ৯ জানুয়ারি সিলেটের নুরানী জুয়েলার্স থেকে ২৫০ ভরি স্বর্ণ চুরি হয়। ওই দিনই ফরিদপুরের প্রগতি জুয়েলার্সে চুরির চেষ্টা হয়। ১২ জানুয়ারি পটুয়াখালীর ঐশী জুয়েলার্স থেকে ৬০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ২ লাখ টাকা চুরি হয়।

২৪ জানুয়ারি ঢাকার হাজারিবাগ ইতি জুয়েলার্স থেকে ৭০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার চুরি হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে ২৫ ভরি স্বর্ণ এবং ২০ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের পুষ্পিতা জুয়েলার্স থেকে ১৪ ভরি স্বর্ণ ও নগদ ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা ডাকাতি হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বনশ্রীতে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে ২০০ ভরি স্বর্ণ ও ২ লাখ টাকা লুট করে সন্ত্রাসীরা।

২৮ ফেব্রুয়ারি মিরপুর-১০-এর শাহ আলী প্লাজা মার্কেটে লুনা জুয়েলার্সে ডাকাতির চেষ্টা হয়। ৯ মার্চ ঝালকাঠিতে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির চেষ্টা হয়। ওই রাতে আশুলিয়াতে নিজ দোকানে দিলীপ কুমারকে কুপিয়ে হত্যা করে ১৫-২০ ভরি স্বর্ণ লুট করে দুর্বৃত্তরা।

২১ এপ্রিল পঞ্চগড়ে গিনি হাউজ জুয়েলার্সে ৫০ ভরি, ১৯ আগস্ট তেজগাঁও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ১৭৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ছিনতাই হয়। ২৭ আগস্ট যশোর অভয়নগরের অপরূপা জুয়েলার্সে ২ ভরি স্বর্ণ ও ১২০ ভরি রুপা চুরি হয়।

৫ অক্টোবর ঢাকার যাত্রাবাড়ী হাজী রায়হান মার্কেটের লিলি গোল্ড হাউজে ১২৫ ভরি, ৯ অক্টোবর ঢাকার ফরচুন শপিং মলের শম্পা জুয়েলার্সে ৫০০ ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার, ১১ নভেম্বর পটুয়াখালী শ্রীগুরু গোল্ড হাউজে ৬ ভরি এবং ১৭ নভেম্বর শেরপুর নয়ানি বাজারে শতরুপা জুয়েলার্সে ১০ ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার চুরি হয়।

পুলিশ অনেক ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করেছে এবং কিছু অলঙ্কার উদ্ধার করেছে।

জুয়েলারি ব্যবসায়ী খুন

গত ২ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাতে নরসিংদীর রায়পুরায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রাণতোষ সরকারকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি দিঘিয়াকান্দি গ্রামে ব্যবসা করতেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুজন চন্দ্র সরকার জানান, চাঁদার টাকা না পেয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।

২০২৪ সালের তিন মাসের চিত্র

৭ সেপ্টেম্বর রাতে রামপুরার মোল্লা টাওয়ারের দ্য মনিকা জুয়েলার্স ও দ্য সুলতানা জুয়েলার্স থেকে ১ হাজার ৯৫ ভরি স্বর্ণ, ৪৫০ ভরি রুপা ও নগদ ১৩ লাখ টাকা ডাকাতি হয়। ২৮ অক্টোবর খুলনার দৌলতপুরে দত্ত জুয়েলার্স থেকে ৫ ভরি স্বর্ণ ও নগদ ২ লাখ টাকা লুট হয়।

একই সময়ে মোহাম্মদপুরের টোকিও স্কয়ার মার্কেটে একটি ডায়মন্ডের দোকানে চুরি হয়। ৮ নভেম্বর লক্ষ্মীপুরে ব্যবসায়ী হীরা লাল দেবনাথ ছুরিকাঘাতে খুন হন। ৯ নভেম্বর মিরপুরের স্পার্কেল জুয়েলার্স ও আবান গোল্ড থেকে সোয়া তিন কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণালঙ্কার লুট হয়।

স্বর্ণ চোরাচালান

২০২৪ সালের জুন মাসে বাজুস দাবি করে, কয়েক মাসে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে প্রায় ২৬ কেজি চোরাচালানের সোনা জব্দ করা হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৬ কোটি টাকা।

এনবিআর ও বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ১০১ কোটি ৮৯ লাখ টাকার সোনা জব্দ করা হয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিজিবি ৯২৫ দশমিক ৯১৯ কেজি চোরাচালানের স্বর্ণ জব্দ করে।

২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিজিবি ২৭ দশমিক ৭১৩ কেজি স্বর্ণ জব্দ করে। শুল্ক গোয়েন্দা, কাস্টম হাউস, বিজিবি, পুলিশ ও এয়ারপোর্ট এপিবিএন সারা দেশে অভিযান চালিয়ে মোট ২ হাজার ৫৮৩ কেজি স্বর্ণ জব্দ করে।

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে যদি স্বর্ণ আমদানি করা হতো, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকে ২২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ জমা হতো, যা থেকে সরকারের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতো।

সিআইডি-পুলিশের তথ্য

একাধিক মামলা তদন্ত করে সিআইডি ও পুলিশ জানতে পারে যে, ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে ডাকাতি করা স্বর্ণ তাঁতীবাজারে গিয়ে বৈধ হয়ে যায়। ডাকাতদের কাছ থেকে কম দামে কিনে কিছু দোকানি এই অলঙ্কার বাজারদরে বিক্রি করেন।

ঢাকার ধানমন্ডি রাপা প্লাজা থেকে ২০০ ভরি স্বর্ণ ও আশুলিয়ায় ১৯টি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির ঘটনায় এক নারীসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পরে ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর অতিরিক্ত ডিআইজি মো. ইমাম হোসেন জানান, তাঁতীবাজারের কালাম বুলিয়ান স্টোর, নিউ খাজা জুয়েলার্স, মুরসালিন জুয়েলার্স, সুমন বুলিং স্টোর ও রাজিয়া বুলিয়েন স্টোর চুরি-ডাকাতির অলঙ্কার কিনে থাকে।

২০২৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামানও কেরানীগঞ্জের জৈনপুরে ডাকাতির ঘটনায় নয়জনকে গ্রেপ্তারের পর অনুরূপ তথ্য জানান।

তাঁতীবাজার বনিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি ইউসুফ শরীফ বলেছেন, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের অলঙ্কার সব এলাকার জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা কমবেশি কেনেন। তাঁতীবাজারের অনেকেই কেনেন, তবে জানাজানি হওয়ায় এখন কেনাবেচা কমেছে।

গত ১৯ আগস্ট ঢাকার তাঁতীবাজারের সুমন জুয়েলার্সের মালিক মনির হোসেনের কাছ থেকে তেজগাঁও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ডিবি পরিচয়ে ১৭৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

এ ঘটনায় গ্রেপ্তার কয়েকজনের তথ্যে সাভার নামাবাজার থেকে গণেশ নামে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।

তার তথ্যের ভিত্তিতে পাশের সঞ্জীত স্বর্ণালয়ে অভিযান চালিয়ে প্রায় ২৪ ভরি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয় এবং সঞ্জীত ঘোষ ও তার কর্মচারী ইমনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সঞ্জীত ধাপে ধাপে ৭৫ ভরি স্বর্ণ কিনেছিলেন।

সাভার পৌর স্বর্ণ-রৌপ্য ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি প্রদীপ কুমার দাস বলেছেন, কোনো ব্যবসায়ী সমিতি বা কাউকে জানিয়ে চোরাই স্বর্ণ বা অলঙ্কার কেনাবেচা করেন না।

এ ব্যাপারে দায়িত্ব নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয়। যদি কেউ চোরাই বা ডাকাতির স্বর্ণ বা অলঙ্কার কিনে ধরা পড়েন, তখনই কেবল বিষয়টি জানাজানি হয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার