রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব এবার স্পষ্টভাবে পড়তে শুরু করেছে ব্যাংকিং খাতে। বড়ো অঙ্কের আমানতকারীরা দ্রুতই ব্যাংক থেকে সরে যাচ্ছেন, কমে যাচ্ছে তাদের হিসাব ও জমা। আর সেই জায়গা ধীরে ধীরে পূরণ করছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের বাড়তি সঞ্চয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, এক বছরে অতি ধনীদের বড় অঙ্কের বহু হিসাব উধাও হলেও ছোট ও মাঝারি আমানতকারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য যা এক নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
পরিসংখ্যান বলছে, মাত্র এক বছরে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানতধারীর হিসাব ৭২টি থেকে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৬টিতে। একই সময় ২৫-৫০ কোটি টাকার হিসাব ১৫১টি থেকে নেমে এসেছে ৭৮টিতে। অর্থাৎ সরকার পরিবর্তনের পর অনেক ধনী গ্রাহক ব্যাংক হিসাব গুটিয়ে নিচ্ছেন, যা ব্যাংকিং খাতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের তথ্য প্রকাশ, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগ এবং সামগ্রিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই বড় অঙ্কের আমানতকারীদের এই সরে যাওয়া। তারা বলছেন, বড় অঙ্কের আমানত কমে যাওয়া ব্যাংকের তারল্যের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
সরকার পরিবর্তনের পর বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ধনী ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে গেছেন। অনেকে জবাবদিহি বা তদন্তের ঝুঁকি এড়াতে ব্যাংক হিসাব গুটিয়ে রিয়েল এস্টেট, স্বর্ণ বা বিদেশে বিনিয়োগে বেশি ঝুঁকছেন। আবার অনেকেই অনিশ্চয়তার কারণে ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ অবস্থানে রয়েছেন। বড় অঙ্ককে ছোট ছোট হিসাবে ভাগ করেও অনেকে অর্থ স্থানান্তর করছেন বলে ধারণা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে বড় অঙ্কের হিসাব কমলেও গত এক বছরে দেশে ব্যক্তি কোটিপতি আমানতকারী বেড়েছে প্রায় আড়াই হাজার এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোটিপতি বেড়েছে প্রায় ৬ হাজার। সামগ্রিকভাবে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৩৬টি, যা এক বছর আগে ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৮৪টি।
ব্যাংক খাতের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত এক বছরে ৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪০০ কোটিতে। ২৫–৫০ কোটি টাকার আমানত কমেছে ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটিতে। এসব তথ্যই বড় অঙ্কের আমানতকারীদের ব্যাংক থেকে সরে যাওয়ার প্রবণতা পরিষ্কার করে।
অন্যদিকে, অতি ক্ষুদ্র, ছোট ও মধ্যম আমানতকারীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। শূন্য থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত হিসাব এক বছরে বেড়ে ১৪ কোটি ৭৬ লাখে পৌঁছেছে। ২ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকার আমানত হিসাব বেড়েছে প্রায় ১৪ লাখ। একইভাবে ২৫–৫০ লাখ, ৫০ লাখ–১ কোটি এবং ১–২৫ কোটি টাকার হিসাবেও লক্ষণীয় বৃদ্ধি হয়েছে।
এতে দেখা যাচ্ছে, বড় ধনী আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে দূরে সরে গেলেও নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সঞ্চয় ও ব্যাংকিং অংশগ্রহণ দ্রুত বাড়ছে- যা দেশে সঞ্চয় সংস্কৃতির বিস্তারের ইঙ্গিত দেয়।