সরকারি সফরের বেশির ভাগ দেশ থেকে বিনিয়োগ কমেছে
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২:২৭ এএম
পুঞ্জীভূত প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ বা এফডিআই স্টক বিবেচনায় বাংলাদেশে বিনিয়োগের শীর্ষ উৎস দেশ যুক্তরাজ্য। কিন্তু দেশটি থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) নিট প্রবাহ কমেছে ৪০ দশমিক ৭১ শতাংশ।
যদিও চলতি বছর মার্চে দেশটি সফর করেন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার কাজে নিয়োজিত সংস্থা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। লন্ডনে অবস্থানকালে যুক্তরাজ্য সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এছাড়া শীর্ষস্থানীয় ব্রিটিশ কোম্পানি ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের সঙ্গেও একাধিক বৈঠক হয় চৌধুরী আশিকের।
প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণের পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। সেখানে তিনি বাংলাদেশে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি, আর্থিক খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশে কোনো বিদেশী ব্যবসায়িক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলেও আশ্বাস দেন।
এরপর বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান চলতি বছরের জানুয়ারিতে। সেখানে তিনি লুইজিয়ানাভিত্তিক জ্বালানি প্রতিষ্ঠান আর্জেন্ট এলএনজির সঙ্গে জ্বালানি সরবরাহবিষয়ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে বিনিয়োগ এসেছে তার চেয়ে বেশি প্রত্যাবাসিত হয়েছে।
এফডিআই স্টক বিবেচনায় বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বিনিয়োগের উৎস দেশ চীন। প্রধান উপদেষ্টা বেইজিং সফরে গিয়েছিলেন মার্চে। পরের মাসে বাংলাদেশে আয়োজিত বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক চীনা বিনিয়োগকারী। এরপর বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান দেশটিতে সফরে যান জুলাইয়ে। ওই সময় তিনি সাংহাইয়ে বিডার উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলকে নেতৃত্ব দেন। সেখানে বাংলাদেশ-চায়না ইনভেস্টমেন্ট সেমিনার ২০২৫-এ প্রধান বক্তা হিসেবে চৌধুরী আশিক চীনা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিদ্যুৎ, টেক্সটাইল ও আইটি খাতে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানান। বিপুল বিনিয়োগের দৃশ্যমান আগ্রহের পাশাপাশি প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গিয়েছিল এসব সফরে। গত অর্থবছরে দেশে চীনের নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে নেদারল্যান্ডস থেকে অস্বাভাবিক হারে বিনিয়োগ বেড়েছে। দেশটি থেকে গত অর্থবছরে নিট এফডিআই বেড়েছে ১ হাজার ৮০০ শতাংশের বেশি। ডাচ্-বাংলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিরা বলছেন, গত অর্থবছরে এ নিট এফডিআই প্রবৃদ্ধিতে কোন প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ভূমিকা রেখেছে সেই তথ্য এখন পর্যন্ত তারা সংগ্রহ করে উঠতে পারেননি।
ডাচ্-বাংলা চেম্বারের প্রতিনিধিরা আরো জানিয়েছেন, নেদারল্যান্ডসের বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগ বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগ করেন। বাংলাদেশে ডাচ্ বিনিয়োগ রয়েছে এমন উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে ওমেরা এলপিজি, এসিআই মটরস ও বিএম এলপি গ্যাস। তবে গত এক-দেড় বছরে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান বড় বিনিয়োগ করেছে, এমন তথ্য তাদের জানা নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে নেদারল্যান্ডস থেকে আসা নিট এফডিআই প্রবাহটি মূলত বাংলাদেশে আকিজ গ্রুপের টোব্যাকো ব্যবসা অধিগ্রহণের বিপরীতে আসা অর্থ। নেদারল্যান্ডসে থাকা জাপান টোব্যাকো বা জেটির কার্যালয় থেকে ব্যবসা অধিগ্রহণের ওই অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের আগস্টে হওয়া এক চুক্তির বিপরীতে সময়াবদ্ধ অর্থ পরিশোধের পেমেন্ট ছিল এটি। বাংলাদেশে আসা এ অর্থপ্রবাহের পেছনে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচারণার কোনো ভূমিকা নেই।
বিনিয়োগের বড় উৎস দেশগুলোর বিনিয়োগ কমলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে নিট এফডিআই প্রবাহ বেড়েছে। এ বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে অধিগ্রহণের বিপরীতে নেদারল্যান্ডস থেকে জেটির পাঠানো অর্থ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুনর্বিনিয়োগ এবং আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আগের অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় নিট এফডিআই বেড়েছে ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মূলধন (ইকুইটি), পুনর্বিনিয়োগ (রিইনভেস্টেড আর্নিংস) ও আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ (ইন্ট্রাকোম্পানি লোন) সংক্রান্ত তথ্যের ভিত্তিতে এফডিআই প্রবাহ বিবেচনায় এ হিসাব প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে দেখা যাচ্ছে এ তিন উপখাতের দুটিতে এফডিআই বেড়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, গত অর্থবছরে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর রিইনভেস্টেড আর্নিংস বেড়েছে ২৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। ইন্ট্রাকোম্পানি লোন বেড়েছে ১৮০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন বা ইকুইটি ক্যাপিটাল কমেছে ১৬ দশমিক ৯০ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট নিট এফডিআই প্রবাহ বাড়লেও তা ঘটেছে কোম্পানিগুলোর পুনর্বিনিয়োগ ও আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণপ্রবাহের কারণে। অর্থাৎ দেশে বিদেশী বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলো নিজস্ব উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে, আবার আয় থেকে পুনরায় বিনিয়োগও করছে। পাশাপাশি এটিও স্পষ্ট যে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে নতুন বিনিয়োগ করছেন না।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের (পিইবি) চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবণতা একটি মিশ্র চিত্র উপস্থাপন করছে। আঙ্কটাডের ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী, ক্যালেন্ডার বছর ২০২৪-এ বাংলাদেশের এফডিআই প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। তবে বিডা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে এফডিআই বেড়েছে। এ বৃদ্ধির বেশির ভাগই বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের পুনর্বিনিয়োগ (রিইনভেস্টমেন্ট) এবং আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ (ইন্ট্রাকোম্পানি লোন) থেকে এসেছে। এটি ইঙ্গিত করে যে বাংলাদেশ নতুন ও গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ আকর্ষণে পিছিয়ে পড়ছে।’
মাশরুর রিয়াজ আরো বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে, সাম্প্রতিক দুই-তিন বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ এবং মুনাফা প্রেরণের (রিপ্যাট্রিয়েশন) জটিল প্রক্রিয়ার কারণে অনেক বিদেশী প্রতিষ্ঠানের জন্য মুনাফা দেশে ফেরত নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। এ কারণে পুনর্বিনিয়োগ কিছুটা বেড়েছে। সুতরাং গত অর্থবছরে এফডিআই বৃদ্ধি যদি নতুন বা গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ থেকে না আসে, তবে তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি দেশের পেশাদার নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরাও একই ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, দেশে যে তিনটি উপখাতে বিদেশী বিনিয়োগের হিসাব করা হয় তার মধ্যে রিইনভেস্টেড আর্নিংস ও আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণের অংশটিই বড় থাকে। তবে বিদেশী বিনিয়োগের প্রকৃত প্রতিফলন পাওয়া যায় মূলত ইকুইটি ক্যাপিটালে, যা হলো নতুন মূলধন। বাংলাদেশে নিয়মিতভাবে নতুন বিদেশী বিনিয়োগ আসতে দেখা যায় না। ফলে এ অংশটি কমই থাকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নিরীক্ষক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইকুইটি কমে গেলে ধরে নিতে হয় যে নতুন বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী না। আর পুনর্বিনিয়োগ ও আন্তঃপ্রতিষ্ঠান ঋণ—বিদেশী বিনিয়োগের এ দুটি উপখাত নানা কারণে ওঠানামা করে। যেমন লভ্যাংশ পাঠাতে না পারা বা স্থানীয় উৎস থেকে কম সুদে বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নেয়া। আর এর পুরোটাই যে বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার হয় তা-ও নয়। ফলে প্রকৃত বিনিয়োগের খাত মূলত ইকুইটি ক্যাপিটাল।’
২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এফডিআই স্টকের উৎস হিসেবে শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় যুক্তরাজ্যের পরেই আছে সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া। তবে শুধু একটি বছরের নিট এফডিআই প্রবাহ বিবেচনায় নিলে গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শীর্ষ দশ দেশের অর্ধেক থেকেই বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহ কমেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে নিট এফডিআই কমেছে এমন দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, কোরিয়া, চীন, ভারত ও শ্রীলংকা।
এদিকে এক বছরে সিঙ্গাপুরের নিট এফডিআই বেড়েছে। এছাড়া বেড়েছে হংকং, মালয়েশিয়া ও জাপান থেকে। এ দেশগুলোর অবদানেই মূলত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নিট এফডিআই প্রবাহ বেড়েছে। এ বৃদ্ধিকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনার পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগ না আসার বিষয়ে সতর্ক হতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বর্তমান বিনিয়োগ পরিবেশে যে ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, সেটাকে ইতিবাচকভাবে দেখতে চাই। প্রবৃদ্ধির পেছনে ইন্ট্রাকোম্পানি লোন বড় একটা ভূমিকা রেখেছে। সামগ্রিকভাবে এক বছরের বিনিয়োগ বিবেচনায় নিলে বলতে হবে বিনিয়োগ যা আসছে তা সম্ভাবনার বিচারে অপ্রতুল। আমাদের মতো উদীয়মান উন্নয়নশীল অর্থনীতির যে সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে এত কম বিনিয়োগ প্রত্যাশিত না। ইকুইটি ক্যাপিটাল কম আসাটা দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য পরিবেশকে ইতিবাচক দেখায় না। এ জায়গায় বলতে হবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নির্বাচন, বিনিয়োগকারীদের জন্য সহায়ক পরিবেশ জরুরি।’
ইকুইটি ক্যাপিটাল কমলেও মোট এফডিআই বৃদ্ধিতে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে বিডার পক্ষ থেকে। সংস্থাটি সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, বাংলাদেশে ‘গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী’ প্রথম বছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বৈশ্বিক প্রবণতার সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থনৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সাধারণত বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বিদেশী বিনিয়োগ হ্রাস পায়, কিন্তু বাংলাদেশ এ ধারায় একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ধারাবাহিক হ্রাসের প্রবণতার বিপরীতে বাংলাদেশে এফডিআইয়ের এ উল্টো চিত্র ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি, যা দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতার এবং বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের গভীর আস্থার প্রতিফলন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, শীর্ষ বিনিয়োগকারী অনেক দেশের বিনিয়োগ বাড়েনি শুধু তা-ই নয়; বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিরা বিনিয়োগ আকর্ষণে যেসব দেশ সফর করেছেন তার অনেকগুলো থেকে বিনিয়োগ কমেছে। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার পর চৌধুরী আশিক গত অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য, কাতার, চীন, মালয়েশিয়া, তুরস্ক ও কোরিয়া সফর করেছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র, ফেব্রুয়ারিতে জাপান, মার্চে যুক্তরাজ্য এবং এপ্রিলে কাতারে (প্রধান উপদেষ্টার প্রতিনিধি দলে) গিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ গত অর্থবছরে এ চারটি দেশ সফর করেছেন। এর মধ্যে কাতার থেকে কোনো বিনিয়োগ আসেনি এবং দুটি দেশ থেকে গত অর্থবছরে নিট এফডিআই কমেছে।
গত অর্থবছরে দেশে নিট এফডিআই বৃদ্ধি নিয়ে সোমবার বিডার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নির্বাহী চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) আশিক চৌধুরী বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গুণ হলো শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাউন্স ব্যাক করার অদ্ভুত ক্ষমতা। এ পরিসংখ্যান তার দারুণ একটা প্রতিফলন। সাধারণত গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বিদেশী বিনিয়োগ প্রচণ্ডভাবে হ্রাস পায়। কিন্তু আমরা দেখছি উল্টা। সঠিক ইকোনমিক পলিসি সেট করা থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ইত্যাদি সংস্থার আন্তরিকতা, আমাদের প্রাইভেট সেক্টরের অদম্য স্পৃহা, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটা হয়েছে। আমরা সব সময় বিনিয়োগকারীদের সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। সব সমস্যার সমাধান অবশ্য হয়নি। কিন্তু সদিচ্ছার কোনো ত্রুটি ছিল না। আমরা শিগগিরই আমাদের সারা বছরের একটা আমলনামা (রিপোর্ট কার্ড) প্রকাশ করব।’
নিট এফডিআই বাড়লেও বিশেষজ্ঞদের মতে, ইকুইটি বিনিয়োগ কমে গেছে ১৬ দশমিক ৯০ শতাংশ, যা উদ্বেগজনক। এটি ইঙ্গিত করে যে পূর্ববর্তী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশে আংশিক আস্থা রাখলেও নতুন বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শুধু নীতিগত নয়, কাঠামোগত সংস্কারও জরুরি। বাংলাদেশে এখনো অনেক প্রক্রিয়া জটিল, সময়সাপেক্ষ এবং অদক্ষ, যা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে।
জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর ফেব্রুয়ারিতে জাপান সফর করেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান। টোকিও ও ওসাকায় বাংলাদেশ দূতাবাস ও বিডার যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ইনভেস্ট বাংলাদেশ রোড শো ২০২৫। গত অর্থবছরে জাপান থেকে নিট এফডিআই বেড়েছে ১৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।
এপ্রিলে কাতারের দোহায় যান বিডা নির্বাহী চেয়ারম্যান। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নিট এফডিআইয়ের প্রধান দেশগুলোর মধ্যে কাতার নেই।
এছাড়া চলতি অর্থবছরের আগস্টে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া ব্যবসায়িক ফোরামে অংশ নেন চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। সেখানে বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে মালয়েশিয়ার বিনিয়োগকারীদের বিশেষ প্রণোদনার সুযোগ ব্যাখ্যা করেন তিনি। উল্লেখ্য, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মালয়েশিয়া থেকে এফডিআই বেড়েছে ৪৯ দশমিক ২১ শতাংশ।
৬ অক্টোবর বিডা, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (মিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব কর্তৃপক্ষের (পিপিপিএ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী আশিকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল ছয়দিনের সফরে তুরস্কে পৌঁছায়। সফরে আয়োজিত সেমিনারে অংশগ্রহণের পাশাপাশি একাধিক জি টু বি পর্যায়ের সভায় অংশ নেন আশিক চৌধুরী। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তুরস্ক থেকে নিট এফডিআই কমেছে ৭৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
চৌধুরী আশিকের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের সরকারি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে কোরিয়ান বিনিয়োগ আকর্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্যে ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর দেশটি সফর করে। উল্লেখ্য, গত অর্থবছরে কোরিয়া থেকে নিট এফডিআই কমেছে ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।