আইসিইউতে থাকা রোগীর চিকিৎসার জন্য, বিদেশে বৃত্তিপ্রাপ্ত সন্তানের জন্য, এমনকি মেয়ের বিয়ের জন্য জমানো টাকাও গ্রাহককে দিতে পারছে না একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকগুলো। গ্রাহকদের অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট পাঁচ ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য জানা গেছে। ব্যাংক মার্জারের ঘোষণা দেওয়া হলেও কার্যকরী কোনো উদ্যোগ না থাকায় এই ব্যাংকগুলো এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। মার্জার উদ্যোগ ঘোষণার পর একদিকে নতুন আমানত আসছে না, অন্যদিকে আপাতত বাংলাদেশ ব্যাংকেরও কোনো সহযোগিতা নেই। ব্যবসা করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। সব মিলিয়ে গভীর সংকটে আছে এই পাঁচ ব্যাংক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত এই ব্যাংকগুলো। গ্রাহকদের পাশাপাশি কর্মকর্তারাও চাপে আছেন। আমানতকারীরা অভিযোগ করে বলেছেন, জমানো টাকা যদি প্রয়োজনে ব্যাংক দিতে না পারে, তাহলে মানুষ কেন সেখানে টাকা রাখবে? এমন সব অভিযোগ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কর্মকর্তাদের সঙ্গে গ্রাহকদের বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে। কখনো কখনো তা মারামারির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণা অনুযায়ী, একীভূত হতে যাওয়া পাঁচটি ব্যাংক হচ্ছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক। নতুন ব্যাংকের নাম এরই মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। ‘ইউনাইটেড ইসলামিক ব্যাংক’ বা ‘সম্মিলিত ইসলামিক ব্যাংক’। আমানতের টাকা ফেরত না পেয়ে এই ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের শেয়ারদরে পতন ঘটেছে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
হতাশার কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের প্রক্রিয়া গ্রাহকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে এবং তারা জমা রাখা টাকা ফেরত পাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তিত। গ্রাহকরা বলেন, এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়া কতটা সফল হবে, তার ওপর গ্রাহকদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এই দুর্ভোগ তো ব্যাংকগুলোর এতদিনের দুরবস্থার ফল। এখন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই ব্যাংকগুলো মার্জারের প্রক্রিয়ায় আছে। ফলে এই ব্যাংকগুলোকে এখন আর বাংলাদেশ ব্যাংক তহবিল জোগান দেবে না- এটাই স্বাভাবিক। মার্জারের পর নতুন ব্যাংকে তহবিল বা টাকা দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার চেষ্টা করছে এগুলোকে একীভূত করে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে আমানতকারীদের পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু গ্রাহকদের এই ধরনের দুর্ভোগ দুঃখজনক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকটির একজন আমানতকারী বলেন, ‘আমার বাবা আইসিইউতে ভর্তি আছেন। টাকার অভাবে তার চিকিৎসা করাতে পারছি না। অথচ বাবা পেনশনের সব টাকাই সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে রেখেছেন। সেই টাকাই এখন সর্বোচ্চ প্রয়োজনের সময় তুলতে পারছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার এই ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু সেটা কবে নাগাদ শেষ হবে, বলছে না। ফলে আমাদের গ্রাহকদের ভোগান্তির লাইন শুধু দীর্ঘ হচ্ছে।’
একীভূত হতে যাওয়া আরেক ব্যাংক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক সংকট এমন পর্যায়ে রয়েছে যে কর্মীদের বেতনও আমানতকারীদের টাকা থেকে দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমি গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম এই ব্যাংকগুলোর তারল্যসংকট ব্যাপক। তারা গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। আমরা এরই মধ্যে তাদের ৪০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছি। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। যখন দেখলাম এগুলোকে ঋণ দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এই পাঁচটি ব্যাংককে এক করব। ভালোভাবে রি-ক্যাপিটালাইজ করব। প্রথমে এটি সরকারি ব্যাংক হিসেবে হবে, পরে এটিকে আমরা প্রাইভেটাইজ (বেসরকারি খাত) করে দেব। তবে এ কাজটি একেবারে সহজ নয় এবং এ জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।’ তিনি মনে করেন, জনবল পুনর্বিন্যস্ত করা, সুশাসন নিশ্চিত করা, নতুন গ্রাহক আনা কিংবা সিস্টেম ডেভেলপমেন্টের মতো বিষয়গুলো চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আসবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো বলছে, তাদের নতুন কোনো আমানত আসছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একসময় যে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছিল, সেটি শেষ হয়ে গেছে। তিন মাসের মধ্যে নতুন কোনো সহায়তাও আসেনি। ফলে ব্যাংকগুলো চাইলেও গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তাদের মারামারির ঘটনাও ঘটছে।
বর্তমানে এই ব্যাংকগুলো ভয়াবহ তারল্যসংকটের মধ্যে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের যে তারল্য সহায়তা দিয়েছিল, তা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এরপর গত তিন-চার মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি। এতে এই ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, এখন আদায় হচ্ছে না, নতুন আমানতও আসছে না। এ অবস্থায় আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গ্রাহকরা তাদের টাকা পাচ্ছে না। এটি আজকের বাস্তবতা, এমনকি এটি কর্মকর্তাদের জন্যও কষ্টদায়ক।
মার্জার প্রক্রিয়া শেষ হতে কতদিন লাগতে পারে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বিষয়ে বলা যাবে না, কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক লাইসেন্সটি ইস্যু করবে, লাইসেন্স হওয়ার পর ব্যাংকের মূলধনসহ ব্যাংকটিকে ওপেন করার ঘোষণা হবে। তারপর হয়তো এক-দুই মাস লাগবে।
একই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রেজিস্ট্রি হওয়া এবং গ্রাহকরা নিয়মিত আমানত পাওয়া পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৫ দিন সময় লাগতে পারে। ১৫ দিন পর প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে। এ সময় প্রশাসক নিয়োগের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থাও হয়তো করা হবে। তবে জরুরি অবস্থায় যদি কেউ টাকা না পায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এই ধরনের ঘটনা ঘটলে এবং তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।