এক হচ্ছে ৫ ব্যাংক: আমানত ফেরতে লাগবে ৬ মাস থেকে ৫ বছর

জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:১৮ পিএম

একীভূত হতে যাওয়া পাঁচটি সমস্যাযুক্ত শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের ব্যক্তি আমানতকারীরা তাদের টাকা ফেরত পাবেন সর্বনিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের মধ্যে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে অর্থ ফেরতের প্রক্রিয়া ও নির্দিষ্ট সময়সূচি উল্লেখ করে একটি বিস্তারিত রোডম্যাপ তৈরি করেছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
রোডম্যাপটি শিগগির সরকারি গেজেটের মাধ্যমে ঘোষণা করা হবে এবং সেখানে উল্লেখিত কার্যকর তারিখ থেকে অর্থ ফেরতের সময়সূচি কার্যকর হবে। গেজেটের খসড়া ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে।
২ লাখ টাকার মধ্যে থাকা সঞ্চয়কে সুরক্ষিত আমানত হিসেবে গণ্য করা হবে এবং একীভূতকরণের পরপরই তা অবিলম্বে পরিশোধ করা হবে।
গত ৯ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদ পাঁচটি ইসলামি ব্যাংক একীভূত করে একটি নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক গঠনের অনুমোদন দিয়েছে। একীভূত ব্যাংকগুলো হলো—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক।
সরকারি সার্কুলারের খসড়া অনুযায়ী, ব্যক্তিগত আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার ধাপটি দুইটি ভাগে বিভক্ত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে, কারণ জনআস্থা ব্যাংকিংখাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
চলতি ও সঞ্চয়ী হিসাবে তিন মাস বা তার বেশি মেয়াদের আমানত বাদে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থকে সুরক্ষিত আমানত হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তা প্রথমেই পরিশোধ করা হবে। গেজেটে উল্লেখিত কার্যকর তারিখের পর যেকোনো সময় এই অর্থ উত্তোলন করা যাবে।
বড় অঙ্কের আমানতের ক্ষেত্রে অর্থ ফেরত দেওয়ার সময়সূচি কার্যকর তারিখের ছয় মাস থেকে ২৪ মাসের মধ্যে প্রতি কিস্তিতে ১ লাখ টাকা করে মোট ছয় কিস্তিতে ফেরত দেওয়া হবে। ২৪ মাসের পর অবশিষ্ট টাকা যেকোনো সময় পরিশোধযোগ্য হবে।
তিন মাস বা তার বেশি মেয়াদের আমানতের ক্ষেত্রেও ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থকে সুরক্ষিত হিসেবে গণ্য করা হবে এবং সার্কুলার কার্যকর হওয়ার পর যেকোনো সময় তা তোলা যাবে।
তিন মাস মেয়াদি স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট) তিনবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়ন করা হবে, তারপর তা উত্তোলনের যোগ্য হবে।
ছয় মাস মেয়াদি আমানত দুবার নবায়ন করা হবে, আর এক বছর মেয়াদি আমানতও দুবার নবায়ন করার পর পরিশোধযোগ্য হবে।
দুই বছর মেয়াদি আমানত স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিন বছরের মেয়াদে রূপান্তরিত হবে, তিন বছর মেয়াদি চার বছরে, আর চার বছর মেয়াদি পাঁচ বছর মেয়াদিতে রূপান্তরিত হবে। পাঁচ বছর বা তার বেশি মেয়াদের আমানত মেয়াদপূর্তির সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধযোগ্য হবে।
সরকারি সার্কুলারের খসড়া অনুযায়ী, ৬৫ বছর বয়সের উর্ধ্বে এবং যারা ক্যানসারে আক্রান্ত, তাদের জন্য এই শর্তাবলী প্রযোজ্য হবে না।
আমানতকারীরা তাদের বাকি থাকা ব্যালেন্সের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ বা ঋণ সুবিধা হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন। গেজেটে উল্লেখিত কার্যকর তারিখ থেকে আমানতের উপর বাজারভিত্তিক মুনাফা অর্জিত হবে।
ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকার, অর্ধ-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার মতো প্রতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের জন্য নতুন ব্যাংকে তাদের নেট দায়বদ্ধতার বিপরীতে অগ্রাধিকার শেয়ার ইস্যু করা হবে। এই শেয়ারগুলোতে প্রযোজ্য ব্যাংক মুনাফা হার প্রযোজ্য থাকবে।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানিক আমানতকারীরাও একই শর্তে শেয়ার পাবেন। শেয়ারগুলো কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে রাখতে হবে, এরপর তা পুনরায় মেয়াদি আমানতে রূপান্তরিত হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং কর্মকর্তাদের ও কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট বা গ্র্যাচুইটি ফান্ড এই স্কিমের বাইরে থাকবে।
নতুন ব্যাংকের জন্য দুটি নাম প্রস্তাব করা হয়েছে—ইউনাইটেড ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড এবং সম্মিলিত ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড।
একীভূতকরণের মাধ্যমে পাঁচটি ব্যাংকের সব সম্পদ ও দায় নতুন ব্যাংকে সংযুক্ত হবে। এই ব্যাংকগুলো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত।
এ বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক অডিটিং ফার্মগুলোর করা ফরেনসিক অডিটে দেখা গেছে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংকে মোট ঋণের ৯৬.৩৭ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংকে ৯৭.৮ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংকে ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংকে ৬২.৩ শতাংশ ও এক্সিম ব্যাংকে ৪৮.২ শতাংশ ঋণ অ-প্রদর্শনযোগ্য (এনপিএল) ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে এই ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত আমানত ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ছিল।
একীভূত হলে নতুন ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ৩৫ হাজার কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের প্রয়োজন। প্রাথমিক মূলধন পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রতিষ্ঠানিক আমানত বেইল-ইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইক্যুইটিতে রূপান্তরিত হতে পারে। সরকার বাকি ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন সহায়তা প্রদান করবে—যার মধ্যে ১০ হাজার কোটি নগদ ও ১০ হাজার কোটি টাকা সুকুকের মাধ্যমে সংগৃহীত হবে, যা বন্ডের মতো শরিয়াহ সম্মত আর্থিক উপাদান।
একীভূত ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ভবিষ্যতও সার্কুলারের খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, অভিযোগ বা মামলার মুখোমুখি নয় এমন পাঁচটি ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকরি নতুন ব্যাংকে স্থানান্তরিত হবে এবং তাদের চাকরি ধারাবাহিক থাকবে।
তবে নতুন ব্যাংকের বোর্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে চাকরিতে অব্যাহত থাকা ব্যক্তিদের জন্য পদ পুনঃনির্ধারণ বা পুনর্গঠন করার ক্ষমতা রাখবে।
যারা চাকরিতে থাকতে চান না, তারা পদত্যাগ করতে পারবেন এবং বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী সব সুবিধা পাবেন। প্রতারণার কারণে দোষী প্রমাণিত কর্মচারীকে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বরখাস্ত করা যাবে।
নতুন ব্যাংকের বোর্ডে নয়জন পরিচালক থাকবেন, যাদের মধ্যে পাঁচজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োগপ্রাপ্ত এবং চারজন প্রধান শেয়ারহোল্ডারদের মাধ্যমে মনোনীত হবেন। পরিচালকরা এক বছরের মেয়াদের জন্য দায়িত্ব পালন করবেন।
প্রাথমিকভাবে অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারের পক্ষে নতুন ব্যাংকের মালিকানা রাখবে। এই অংশ ধীরে ধীরে বেসরকারি খাতে হস্তান্তরিত হবে।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিন বছরের মধ্যে ব্যাংকে একটি কৌশলগত অংশীদার আনা হবে এবং পাঁচ বছরের মধ্যে এটি সম্পূর্ণভাবে বেসরকারিকরণ হওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।