পাঁচ ব্যাংক একীভূত নিয়ে ‘ধোঁয়াশা’, ‘বলির পাঠা’ সাধারণ বিনিয়োগকারী

জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৪৮ পিএম

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক একীভূত করে নতুন একটি ব্যাংক করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইসলামি ব্যাংক পাঁচটি একীভূত করার পর বর্তমান সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কী হবে- সে বিষয়টি খোলাসা করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বারবার ‘বলির পাঠা’ হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
বিষয়টি নিয়ে শেয়ারবাজারে একেক সময় একেক রকম গুঞ্জন ছড়াচ্ছে। প্রথম দফায় গুঞ্জন ছড়ায়- একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা কিছুই পাবেন না, এতে এই পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার দামে ব্যাপক দরপতন হয়। এরপর গুঞ্জন ছড়ায়- বর্তমান শেয়ারহোল্ডাররা কিছু না কিছু পাবেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে আবার শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে।
অতি সম্প্রতি আবার গুঞ্জন ছড়িয়েছে পাঁচ ব্যাংকের সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা কিছুই পাবেন না। ফলে আবারও এই ব্যাংকগুলোর শেয়ার বড় দরপতনের মধ্যে পড়েছে। এমনকি কয়েক কার্যদিবস ধরে দিনের সর্বনিম্ন দামে প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের বিক্রি আদেশ এলেও ক্রয় আদেশের ঘর পড়ে থাকছে শূন্য।
পাঁচ ব্যাংক একীভূত করার পর সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কী হবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট করা হচ্ছে না। আমরা চাই এ বিষয়ে একটি পরিষ্কার ধারণা দেওয়া হোক।- ডিএসইর পরিচালক মো. শাকিল রিজভী
শেয়ারবাজারে নানান গুঞ্জন ছড়ালেও এই পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান শেয়ারহোল্ডারদের ভাগ্যে কী জুটবে, তা স্পষ্ট করছে না বাংলাদেশ ব্যাংকও। এ নিয়ে ধোঁয়াশা থাকায় এদিকে যেমন এই পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারের ব্যাপক দরপতন হচ্ছে, অন্যদিকে সার্বিক শেয়ারবাজারেও ঢালাও দরপাতন হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত বিনিয়োগ করা পুঁজি হারাচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
এ পরিস্থিতিতে পাঁচ ব্যাংক একীভূত হওয়ার পর বর্তমান সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের ভাগ্যে কী জুটবে, সে বিষয়টি দ্রুত স্পষ্ট করার দাবি জানাচ্ছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে সম্প্রতি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই চিঠিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে পাঁচ ব্যাংক একীভূত করার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ‘ব্যাংক রেজ্যুলেশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫’-এ যেভাবে বলা হয়েছে, পাঁচ ব্যাংক একীভূত সেভাবে করা হবে। আর এই একীভূত প্রক্রিয়া শেষ হতে কমপক্ষে দুই বছর লেগে যাবে।
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা পাঁচ ব্যাংকের বর্তমান অবস্থার জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দায় নেই। এজন্য দায়ী ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা। যারা দায়ী তারা চিহ্নিত, সুতরাং তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা দরকার। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে শেয়ার কিনে তো কোনো পাপ করেনি। তাহলে কেন, তারা বলির পাঠা হবে।
তারা আরও বলছেন, এই পাঁচ ব্যাংকের বর্তমান সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা একীভূত হয়ে সৃষ্টি হওয়া নতুন ব্যাংকের শেয়ার পাবেন নাকি পাবেন না, সে বিষয়টিও পরিষ্কার করা হচ্ছে না। আর সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা যেহেতু লুটপাটে দায়ী না, সুতরাং তাদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করা কিছুতেই ন্যায়সঙ্গত হবে না। এমনটি করা হলে শেয়ারবাজারের ওপর থেকে সবার আস্থা নষ্ট হবে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, একীভূত হওয়ার পর পাঁচ ইসলামি ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার শূন্য ঘোষণা করা হবে এবং সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা কিছুই পাবে না- এমন গুঞ্জন ছড়ালে ব্যাংকগুলোর শেয়ারের ব্যাপক দরপতন হয়। এতে দফায় দফায় দরপতন হয়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ১৩ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ৩ টাকায় নেমে আসে।
বাকি চার ব্যাংকের মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের শেয়ার ১১ টাকা থেকে ২ টাকা ৮০ পয়সায়, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ৮ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ১ টাকা ৮০ পয়সায়, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ৮ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ১ টাকা ৩০ পয়সায় এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের শেয়ার ৮ টাকা ২০ পয়সা থেকে ১ টাকা ৪০ পয়সায় নেমে যায়।
এই রেকর্ড দরপতনের পর বাজারে গুঞ্জন ছাড়ায় ব্যাংকগুলোর সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা একীভূত হওয়ার পর কিছু না কিছু পাবেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোর শেয়ার দাম কিছুটা বাড়তে দেখা যায়। কিন্তু গত ৯ অক্টোবর সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা এক তথ্যে বলা হয়, ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ ও ব্যাংক রেজ্যুলেশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর বিধান অনুযায়ী হস্তান্তরকারী ব্যাংকগুলোর মালিক/শেয়ারহোল্ডারদের পাওনা নিষ্পত্তি হবে।
এতে আরও বলা হয়, আইন অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর মালিকানা দায় দ্বারা সীমিত। ফলে হস্তান্তরকারী ব্যাংকগুলোর উচ্চ মূলধন ঘাটতি ও এনএভি ঋণাত্মক থাকায় এ মার্জার প্রক্রিয়ায় মালিক/শেয়ারহোল্ডারদের কোনো দাবি পরিশোধের সুযোগ নেই। তবে ব্যক্তি আমানতকারীদের জমা করা অর্থ ব্যাংক রেজ্যুলেশন পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিশোধ করা যেতে পারে এবং সে লক্ষ্যে প্রয়োজনে আমানত সুরক্ষা তহবিলের অর্থ ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই তথ্য প্রকাশের পর থেকে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা ব্যাংকগুলোর শেয়ার দাম আবার কমতে শুরু করেছে। সবশেষ রোববার (১২ অক্টোবার) ব্যাংক পাঁচটির শেয়ার দিনের সর্বনিম্ন দামে বিপুল পরিমাণ বিক্রির বিক্রয় আদেশ আসে, বিপরীতে শূন্য হয়ে পড়ে ক্রয় আদেশের ঘর। ক্রেতা সংকটে ব্যাংক পাঁচটির অল্প কিছু শেয়ার দিনের সর্বনিম্ন দামে লেনদেন হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর এক সদস্য বলেন, ‘পাঁচ ব্যাংক একীভূত করা নিয়ে বাজারে নানান গুঞ্জন ছড়ানো হচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সার্বিক বাজার। কিন্তু সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের ভাগ্যে কী জুটবে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কিছুই স্পষ্ট করা হচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে বর্তমান সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা কিছুই পাবেন না। এমনটা হলে তা কিছুতেই ন্যায়সঙ্গত হবে না। বরং, এর মাধ্যমে ব্যাংক লুটেরাদের দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মুখে ফেলা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘পাঁচটি ব্যাংক যে দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে, তার জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো দায় নেই। কারা ব্যাংকের অর্থ লুট করেছে, তা ইতোমধ্যে চিহ্নিত। সুতরাং, যারা অপরাধী তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু আমরা দেখছি ব্যাংক লুটেরারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর যত দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। তাদের কথা শোনার মতো যেন কেউ নেই।’
এ বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, ‘পাঁচ ব্যাংক একীভূত করার পর সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কী হবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট করা হচ্ছে না। আমরা চাই এ বিষয়ে একটি পরিষ্কার ধারণা দেওয়া হোক।’
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘পাঁচ ব্যাংক একীভূত হওয়ার পর এর শেয়ার কী হবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট করা উচিত। বিষয়টি স্পষ্ট না করার কারণে বাজারে নানান গুঞ্জন ছাড়াচ্ছে এবং বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’
বাজারে গুঞ্জন ছড়িয়েছে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা কিছুই পাবেন না। এমন কথা বলা হলে তিনি বলেন, ‘এমনটা করা হলে সেটি কিছুতেই ন্যায়সঙ্গত হবে না। সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা তো কোনো অপরাধ করেননি। এমনটি করা হলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে আমরা কিন্তু বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে দেখছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যারা সংশ্লিষ্ট পক্ষ, আমরা যারা বিনিয়োগকারীদের প্রটেক্ট করি, আমাদের সঙ্গে তো আলাপ করা উচিত ছিল। এই ভূমিকাটা তো আমরা আশা করেছিলাম। আমাদের অভিমত সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দাবি বিবেচনায় নেওয়া উচিত।’
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম বলেন, ‘একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা ব্যাংক পাঁচটির দুরবস্থার জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দায়ী না। এজন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে ব্যাংক পাঁচটি একীভূত করতে বিএসইসি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা চিঠিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ নির্ধারণের বিষয়ে বলেছি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন বলেন, ‘সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা যা পাওয়ার, তাদের কতটুকু দায় বা মুনাফা সে অনুযায়ী তাদের অ্যাসেট (সম্পদ) বা দায় নিতে হবে।’
শেয়ারবাজারে গুঞ্জন ছড়িয়েছে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার শূন্য ঘোষণা করা হবে। এটা কতটা সত্য? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এখন মার্জারের (একীভূত) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মার্জ করতে গেলে এ রকম অসংখ্য জিনিস উঠে আসবে, ‘ব্যাংক রেজ্যুলেশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫’ অনুযায়ী সব ধাপে ধাপে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।’
বাজার থেকে যে বিনিয়োগকারী শেয়ার কিনেছেন, তার অপরাধ কী? কেন তার শেয়ার শূন্য ঘোষণা করা হবে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ব্যাংক রেজ্যুলেশন অর্ডিন্যান্সে যেভাবে বলা আছে, সেটিই ফলো করতে হবে। আমরা তো কারও অপরাধ নিরূপণ করতে নামিনি।’ তিনি বলেন, ‘সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার শূন্য ঘোষণা করা হবে, এমন কোনো সিদ্ধান্ত কিন্তু এখনো হয়নি। একটা জিনিস অনুমান করে গুজব ছড়ানো ঠিক নয়।’
সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কিছু পাবেন নাকি কিছুই পাবেন না, সে বিষয়টি কেন আপনারা স্পষ্ট করছে না? এমন প্রশ্ন করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ‘মার্জার এখনো হয়নি। মার্জার করতে কমপক্ষ দুই বছর লাগবে।’