Logo
Logo
×

সারাদেশ

দৃষ্টিহীন জীবনে শিক্ষার দীপশিখা উম্মে মাকতুম মাদরাসা ও স্কুল

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ১২:২৩ পিএম

দৃষ্টিহীন জীবনে শিক্ষার দীপশিখা উম্মে মাকতুম মাদরাসা ও স্কুল
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের দেখার কিংবা পড়ালেখার সক্ষমতা হয়ত সীমিত তবুও তাদের মনোবল, ইচ্ছাশক্তি আর অধ্যবসায় অসীম। যাদের চোখে আলো নেই, কিন্তু হৃদয়ে আছে জ্ঞানের আলো আর বিশ্বাসের জোয়ার, তাদের শিক্ষার সুযোগ দিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোবরাতলা ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে এক ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান। উম্মে মাকতুম অন্ধ মাদরাসা ও স্কুল নামের এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধকতা তাদের জীবনকে থামাতে পারেনি, অন্ধকারেই তারা খুঁজছেন আলোর উৎস। নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে পরিণত করেছেন শক্তিতে, অসহায়ত্বকে বদলে দিয়েছেন সম্ভাবনায়।

স্কুলটিতে গিয়ে দেখা যায়, সকাল শুরু হয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কোরআন তেলাওয়াতের সুরে। ব্রেইল লিপিতে লেখা বইয়ের পাতায় তাদের আঙুল ছুঁয়ে যেন জেগে ওঠে শিক্ষার আলো। অন্ধকারে থেকেও ভবিষ্যতের স্বপ্ন গড়তে শেখাচ্ছে এই শিক্ষালয়। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে বাজে জীবনের জয়গান।

উম্মে মাকতুম অন্ধ মাদরাসা ও স্কুলের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী আলি হোসেন জানান, ‘জন্ম থেকেই চোখে আলো নেই। তবুও শিক্ষার প্রতি আগ্রহ আর নিজের ভেতরের শক্তিই তাকে প্রতিদিন এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়। তিনি বলেন, চোখে দেখি না এটা সত্যি। কিন্তু তাই বলে জীবন তো থেমে থাকতে পারে না। নিজের চেষ্টায় নিয়মিত পড়াশোনা করি, মনে রাখি। সামনে আরও বড় হতে চাই। সবাই যেমন স্বপ্ন দেখে, আমিও তেমনই স্বপ্ন দেখি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার।’

ইয়াসমিন আরা নামে এক ছাত্রী বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে জীবনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল একাকিত্ব আর সামাজিক অবহেলা। ছোটবেলা থেকেই বাড়ির লোকেরা খুব একটা গুরুত্ব দিত না। বাইরে যাওয়া, মানুষের সঙ্গে কথা বলা, কিংবা নিজের মতো করে কিছু করার সুযোগও ছিল না। বাড়িতে বসে থেকে দিন কাটত। না পড়াশোনা, না কোনো কাজ, কিছুই হতো না। পরিবারের অনেকেই আমাকে ভালো চোখে দেখতো না, কারণ আমি চোখে দেখতে পাই না। অনেক সময় মনে হতো, আমি হয়ত কারও প্রয়োজনই না। খুব কষ্ট হতো।’

‘এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর বুঝলাম, আমারও কিছু করার ক্ষমতা আছে। এখানে আমাদের কোনো খরচ দিতে হয় না। শিক্ষকরা নিজেরাও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, তাই তারা আমাদের কষ্টটা মন থেকে বুঝতে পারেন। খুব ধৈর্য ধরে শেখান। এখন আমার সময় আর ঘরে বসে কাটে না, প্রতিদিন নতুন কিছু শিখছি।’

তিনি বলেন, ‘পরে একদিন এলাকার একজনের মাধ্যমে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষভাবে গড়ে ওঠা উম্মে মাকতুম অন্ধ মাদরাসা ও স্কুল সম্পর্কে জানতে পারি। সেখানে ভর্তি হয়ে যেন নতুন করে জীবনের দরজা খুলে যায় আমার সামনে।’

আব্দুর রহমান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর বুঝলাম, আমারও কিছু করার ক্ষমতা আছে। এখানে আমাদের কোনো খরচ দিতে হয় না। শিক্ষকরা নিজেরাও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, তাই তারা আমাদের কষ্টটা মন থেকে বুঝতে পারেন। খুব ধৈর্য ধরে শেখান। এখন আমার সময় আর ঘরে বসে কাটে না, প্রতিদিন নতুন কিছু শিখছি।’

উম্মে মাকতুম অন্ধ মাদরাসা ও স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের কাজিপাড়া গ্রামের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মোহাম্মদ আব্দুর সবুর। তিনি জানান, চোখে আলো না থাকলেও হৃদয়ের দৃঢ়তা, মেধার উজ্জ্বলতা আর ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন নিজের পথ। ব্রেইল পদ্ধতিতে কোরআনের হাফেজ হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষায় স্নাতক সম্পন্ন করেছেন সবুর। কম্পিউটারেও দক্ষতা অর্জন করেন তিনি।

‘জন্ম থেকেই আমাকে অনেকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো। সেই উপহাসই আমার এগিয়ে যাওয়ার শক্তি হয়েছে। তাই আমার মতো আরও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী যেন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়, সেই চিন্তা থেকেই এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা।’

মোহাম্মদ আব্দুর সবুর বলেন, ‘জন্ম থেকেই আমাকে অনেকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো। সেই উপহাসই আমার এগিয়ে যাওয়ার শক্তি হয়েছে। তাই আমার মতো আরও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী যেন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়, সেই চিন্তা থেকেই এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা।’

স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছে ত্রিবেণী ট্রাস্ট। তাদের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য পুরোপুরি বিনামূল্যে পরিচালিত হয়।
এ শিক্ষা যাত্রায় পিছিয়ে নেই নারী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরাও। তারা বলছেন, সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে শিক্ষা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য এমন স্কুল সত্যিই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমরা সরকারি দিক থেকে যেকোনো সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।’

বর্তমানে উম্মে মাকতুম অন্ধ মাদরাসা ও স্কুলে ১৫ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। সংশ্লিষ্টদের আশা, সরকারি সহযোগিতা পেলে এই প্রতিষ্ঠানটি আরও বেশি শিক্ষার্থীকে শিক্ষার আলো দিতে সক্ষম হবে।

ত্রিবেণী ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ডা. আনোয়ার জাহিদ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী করা। এজন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি।’
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা কাঞ্চন কুমার দাস বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য এমন স্কুল সত্যিই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমরা সরকারি দিক থেকে যেকোনো সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার