Logo
Logo
×

সারাদেশ

‘যদি ফোন বন্ধ পাও, ধরে নিও আমি আর বেঁচে নেই’

Icon

জাগো বাংলা ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৪ পিএম

‘যদি ফোন বন্ধ পাও, ধরে নিও আমি আর বেঁচে নেই’

রাশিয়ায় গিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন রাজবাড়ীর অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য নজরুল ইসলাম (৪৭)। দীর্ঘ সাত মাস ধরে নিখোঁজ থাকার পর অবশেষে গত ৮ অক্টোবর বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নজরুলের মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে তার পরিবারকে। খবর পেয়ে নজরুলের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য নজরুল ইসলাম সদর উপজেলার রামকান্তপুর চরপাড়া গ্রামের মৃত হাতেম আলী ফ‌কিরের ছেলে। চার কন্যাসন্তানের জনক ছিলেন তিনি। তার বড় মেয়ে রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।মেজো মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।আর ছোট দুই মেয়ের একজনের বয়স ছয় বছর, আরেকজনের পাঁচ।

শুক্রবার (১০ অক্টোবর) সকালে সরেজমিন নজরুলের স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তার বাড়িতে গিয়ে কথা বলে জানা যায়, নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ল্যান্স কর্পোরাল পদে কর্মরত ছিলেন এবং ২০২০ সালে তিনি অবসরে যান। ২০১৩ সালে তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিতে কঙ্গো গিয়েছিলেন। অবসরের পর থেকে বাড়িতেই থাকতেন। কিছুদিন পর রাজবাড়ীর শ্রীপুর বাজারে মুদি ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু একটা সময় ব্যবসায় বড় লোকসান হওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়েন।

এ অবস্থায় স্থানীয় দালাল ফরিদ হোসেন তাকে রাশিয়ার শ‌পিংমলে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখান। বিদেশ যাওয়ার বিষয়‌টি স্ত্রী আইরিন আক্তার জানার পর নানা উপায়ে স্বামীকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু নজরুল তার স্ত্রীকে বোঝান- রাশিয়ায় ভালো বেতন পাওয়া যাবে এবং সংসারের অবস্থা আরও ভালো হবে। 

আরও পড়ুন
এরপর চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি রাশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছানোর পর এক মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ ‌নিতে তাকে বাধ্য করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয় তাকে। তখনো নিয়‌মিত প‌রিবারের সঙ্গে ভি‌ডিও কলে কথা বলতেন নজরুল। 

নজরুল একদিন ফোনে স্ত্রীকে জানান, ‘আমার আর বিদেশ থেকে ফেরার কোনো উপায় নেই। আমার ফোন বন্ধ পেলে তোমরা ভেবে নিও আমি মারা গে‌ছি’।

পরিবারের সঙ্গে তার সর্বশেষ কথা হয় গত ৩০ এপ্রিল। সেইদিন নজরুল তার স্ত্রীকে আরও জানান— তিনি ব্যাংকে যাচ্ছেন টাকা পাঠাতে। এর কিছুক্ষণ পরই ফের ফোন করে বলেন, ‘আমার আর টাকা পাঠানো হলো না, দ্রুত যেতে হচ্ছে। যদি ফোন বন্ধ পেয়ে থাকো তাহলে ধরে নিও আমি আর বেঁচে নেই’।

সেটাই ছিল তার শেষ কথা। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ মেলেনি।

দীর্ঘ সাত মাস ধরে পরিবারের সদস্যরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ ঢাকার বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করলেও কোনো তথ্য পাননি। অবশেষে গত ৮ অক্টোবর বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ফোন করে তার পরিবারকে জানানো হয়— ‘নজরুল ইসলাম মারা গেছেন’।

নিহতের স্ত্রী আইরিন আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী অবসরের পর বাড়িতেই থাকতেন। ব‌্যবসায় লোকসান হওয়ায় ফ‌রিদ দালালের মাধ‌্যমে রা‌শিয়ায় যান। আমি বারবার নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম, সন্তানদের নিয়ে আমরা এক সঙ্গে থাকব। কিন্তু সে বলল, রাশিয়ায় ভালো চাকরি আ‌ছে, নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ।’

‘চার মেয়েকে নিয়ে এখন কিভাবে বাঁচব’ আর্তচিৎকার দিয়ে আইরিন আক্তার বলেন, ‘আমার এখন একটাই চাওয়া— সরকার আমার স্বামীর লাশটা অন্তত আমার কাছে এনে দিক। শেষবার আমি একটু আমার স্বামীকে দেখতে চাই’।

নজরুল ইসলামের বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট রহিম বলেন, ফরিদ নামের দালাল আমার ভাইকে প্রলুব্ধ করে রাশিয়ায় পাঠিয়েছে। আমরা বহু জায়গায় খোঁজ নিয়েছি। ফরিদ সব সময় বলতো— ‘ও বেঁচে আছে, নেটওয়ার্ক না থাকায় যোগাযোগ করতে পারছে না। এখন শুনলাম ও আর বেঁচে নেই’। 

তিনি বলেন, আপনাদের মাধ্যমে জানাই সরকার যেন আমার ভাইয়ের লাশটা দেশে আনার ব্যবস্থা করে দেয়।

অভিযুক্ত ফরিদের সঙ্গে ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ‘নজরুলকে আমি রাশিয়া পাঠাইনি। সে গেছে বিকন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস এজেন্সির মাধ্যমে। আমি শুধু যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি। সে সব জেনে-শুনেই গেছে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর লজিস্টিক হ্যান্ড হিসেবে। নো অব‌জেকশন সা‌র্টিফি‌কে‌টে স্বাক্ষরও ক‌রে গে‌ছে। আমি গত রাতে শুনেছি, মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে নজরুল মারা গেছেন। এখা‌নে আমার দোষ দি‌য়ে লাভ কোনো লাভ নেই’। 

এ বিষয়ে রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মারিয়া হক যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি আমি সাংবাদিকদের কাছ থেকেই জেনেছি। অফিসিয়ালি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের এ ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি। কিংবা কোনো চিঠিও আমাদের কাছে আসেনি। তারপরও বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি এবং নজরুলের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে লাশ ফেরতের বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার