পাসপোর্ট সেবায় ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হঠাৎ নজর এনআইডিতে!

জাগো বাংলা ডেস্ক প্রকাশিত: ১০:১২ এএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২
পাসপোর্ট সেবায় ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হঠাৎ নজর এনআইডিতে!

সরকারের অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান থেকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) কার্যক্রম বেশ স্বচ্ছ। মাত্র ১৫ বছর আগে এর যাত্রা। ইতোমধ্যে সব কার্যক্রম ডিজিটাল পদ্ধতিতে (অনলাইন) সম্পন্ন হচ্ছে। ভোটার তালিকায় যুক্ত হওয়া প্রায় সাড়ে ১১ কোটি নাগরিককে পদ্ধতিগত উন্নয়নের মাধ্যমে খুব সহজেই সেবা দিয়ে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। মাঠপর্যায়ে কিছু ভোগান্তি থাকলেও নির্বাচন কমিশনের অধীনে এনআইডি’র কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে ভালোভাবেই। কিন্তু হঠাৎ করে এর ওপর নজর পড়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের!

দেশব্যাপী নিজস্ব অফিস ও জনবল দিয়ে পাসপোর্টের নির্বিঘ্ন সেবা দিতে ব্যর্থ হওয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ সাড়ে ১১ কোটি নাগরিকের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে! এতে জনভোগান্তি যেমন বাড়বে, তেমনি প্রতি বছরই সরকারের গচ্ছা দিতে হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা

দেশব্যাপী নিজস্ব অফিস ও জনবল দিয়ে পাসপোর্টের নির্বিঘ্ন সেবা দিতে ব্যর্থ হওয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ সাড়ে ১১ কোটি নাগরিকের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে! এতে জনভোগান্তি যেমন বাড়বে, তেমনি প্রতি বছরই সরকারের গচ্ছা দিতে হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা— বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগ (এনআইডি) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে স্থানান্তরের জন্য গত বছর (২০২১ সাল) টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের আদেশ জারি করা হয়। প্রায় এক বছর পর গত ২১ জুলাই সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমানকে টেকনিক্যাল কমিটির আহ্বায়ক করা হয়।

গত ৭ আগস্ট সুরক্ষা সেবা বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামোতে ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন’ অনুবিভাগ গঠন এবং এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় পদ সৃজনের যৌক্তিকতা নির্ধারণের লক্ষ্যে মিটিং করেন সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব। গত ১১ আগস্ট সুরক্ষা সেবা বিভাগের এ সংক্রান্ত আরেকটি সভা হওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে তা বাতিল করা হয়।

টেকনিক্যাল কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছিল, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে সুরক্ষা সেবা বিভাগে আনয়নের লক্ষ্যে কারিগরি বিষয় যাচাইপূর্বক স্থানান্তরের পদ্ধতি/প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়ন, স্থানান্তর যোগ্য অবকাঠামো/জনবল চিহ্নিত করে স্থানান্তরের পদ্ধতি সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়ন, এতদসংক্রান্ত আনুষঙ্গিক বিষয়াদি, নির্বাচন কমিশন হতে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের জন্য একটি সুপরিকল্পিত রোডম্যাপ প্রণয়ন করা। এছাড়া বলা হয়, কমিটি প্রয়োজনে সদস্য কো-অপট করতে পারবে।

গত বছরের ১৭ মে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে ন্যস্ত করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর চিঠি দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-১০ এ কে এম ফজলুর রহমান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এনআইডি চাইলেই নিতে পারবে না। কারণ, এর (এনআইডি) নিজস্ব কিছুই তো নেই। ভোটার তালিকা থেকে সবাইকে এনআইডি দেওয়া হয়। এর কোনো আলাদা ডাটাবেজ নেই বা নিজস্ব জনবলও নেই। নির্বাচন কমিশনের জনবলেই চলছে এনআইডি কার্যক্রম। এছাড়া, প্রকল্পের মাধ্যমে আউটসোর্সিং থেকে কিছু জনবল নিয়ে এনআইডি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ইসি থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী নেবে?

কর্মকর্তারা আরও বলেন, স্বরাষ্ট্র এনআইডি নিতে চাইলে ভোটার তালিকার মূল ডাটাবেজ বা কপি নিতে পারবে। তবে এখানে কথা থাকে, নির্ভুল ভোটার তালিকা ও ডাটাবেজ সংরক্ষণ করা নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সেক্ষেত্রে ভোটার তালিকার ডাটাবেজ নির্বাচন কমিশন ছাড়া অন্য কারও কাছে থাকতে পারবে না। এছাড়া, স্বরাষ্ট্র যদি এনআইডি নিয়েই নেয়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই এনআইডি সংশোধনের বিভিন্ন ধরনের আবেদন থাকে যেগুলো তাদের সংশোধন করতে হবে। এক্ষেত্রে দেখা যাবে, নির্ভুল ভোটার তালিকার সঙ্গে সংশোধন হওয়া এনআইডি’র দূরত্ব বাড়বে। মানে, স্বরাষ্ট্র জোর করে এনআইডি নিলেও নানামুখী সমস্যায় পড়তে পারে। যার প্রভাব সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সরকারের ওপর পড়বে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনআইডি’র এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অস্বাভাবিক পরিশ্রমের মাধ্যমে তিল তিল করে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করি। পরবর্তীতে ওই তালিকার তথ্যানুযায়ী নাগরিকদের এনআইডি ও স্মার্টকার্ড দেওয়া হয় এবং হচ্ছে। বর্তমানে এনআইডি ছাড়া সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানই সেবা দেয় না। এনআইডি’র গুরুত্ব বাড়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কু-নজর পড়েছে। ফলে নির্বাচন কমিশনে সেভাবে কিছু না জানিয়েই তারা এনআইডি নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা যারা এখানে (এনআইডি) দায়িত্ব পালন করছি, সবাই যথাযথ ডকুমেন্ট না থাকলে এনআইডি সংশোধনের আবেদন নিষ্পত্তি করি না। বিশেষ করে চাকরিজীবীদের সংশোধনী আবেদনে অনেক কাগজপত্র দিতে হয়। চাকরিজীবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন আসে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও বিজিবি’র। যেকোনো সরকারি চাকরিজীবী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যথাযথ ডকুমেন্ট দিতে ব্যর্থ হন। ফলে সেগুলো আর সংশোধন হয় না। এ কারণে তাদের মন খারাপ হওয়ার কথা। মূলত, এনআইডি নেওয়ার পেছনে অনেক ষড়যন্ত্র কাজ করছে। এগুলো চাইলেও বলা সম্ভব নয়।

নির্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে এনআইডি সেবায় নিজস্ব কোনো বরাদ্দ বা বাজেট নেই। নির্বাচন কমিশনের বাজেটেই দেশব্যাপী এনআইডি সেবাকার্যক্রম চলছে। তবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এনআইডি নিয়ে গেলে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা জনবলের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় হবে। এর বাইরেও সার্ভার ও অবকাঠামো উন্নয়নে অনেক বড় প্রকল্প হাতে নিতে হবে। অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনের অধীনে এনআইডি থাকায় সংস্থাটির লাভের অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্রের অধীনে চলে গেলে প্রতি বছরই কয়েক হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে। বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটে টালমাটাল দেশ। সরকারকে আরও অর্থনৈতিক চাপে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছে কিছু স্বার্থান্বেষী আমলা। ফলে এনআইডি নিয়ে এত তোড়জোড়।

নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি যতটুকু শুনেছি এবং পত্রিকায় দেখেছি, নির্বাচন কমিশন অনেক আগে থেকেই কাজটা করে আসছে। প্রথমে এটা ভোটার লিস্ট বেজড ছিল। এরপর কিন্তু এনআইডি’র জন্ম হয়। আমি নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব নেওয়ার পর শুনছি এটা নাকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চলে যাবে। তবে, এ সম্পর্কিত এখনও কোনো কাগজপত্র দেখিনি।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, গোড়ার ইতিহাস হলো এটা (এনআইডি) আদৌ নির্বাচন কমিশনের করার কথা ছিল না। সত্যিকার অর্থে, জাতীয় পরিচয়পত্রটা নির্বাচন কমিশনের অধীন হওয়ারও কথা ছিল না। এটা সরকারি কার্যক্রমের একটা অংশ। প্রথমে ১৯৯৬ সালে ভোটার কার্ড করা হয়। এরপর ২০০৭ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন আমি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ফিজিবিলিটি স্টাডি করি। সর্বপ্রথম গাজীপুরের দুটি জায়গায় এর মডেল করি। ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্টে দেখা যায়, ফুল সেট-আপ নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারের ছবি তোলা সম্ভব নয়। এরপর এটা কীভাবে প্রয়োজনীয় করা যায়, তার উপায় বের করলাম। ভোটাররা যেন তাদের নিজ প্রয়োজনে ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়ে ছবি তোলেন, সেই ব্যবস্থা করলাম। বিশেষ করে কিছু সেবা এনআইডিতে যুক্ত করে আইন করা হয়। যেহেতু নির্বাচন কমিশনের অধীনে এনআইডি রেখে আইন করা হয়, সেজন্য এটা নির্বাচন কমিশনের অধীনে আছে।

নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ১০ জন। এর মধ্যে পাঁচ কোটি ৭৬ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৯ জন পুরুষ, পাঁচ কোটি ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ২৭ জন নারী এবং ৪৫৪ জন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য রয়েছেন। প্রথম থেকে এনআইডি হারানো ও সংশোধন সংক্রান্ত সেবা বিনামূল্যে দিলেও ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ফি নেওয়া শুরু করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।লা ও বিভাগ-পর্যায়ে অফিস লাগবে। দেশ বর্তমানে সংকটে আছে বলে আমার ধারণা। আমি মনে করি, এ সময়ে বিনিয়োগ, জনবল, প্রশিক্ষণ ও নিজস্ব অফিস নির্মাণের মতো কাজগুলো করার আগে এটা নেওয়া ঠিক হবে না। ব্যাপারটা আরও ভেবে দেখা উচিত সরকারের।’