যে কারণে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এবার ফল ভালো

জাগো বাংলা ডেস্ক প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ২৯ নভেম্বর ২০২২
যে কারণে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এবার ফল ভালো

সোমবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। এসএসসিসহ ১১টি শিক্ষা বোর্ডে পাশের হার ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। যা গত বছর ছিল ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর সর্বোচ্চ সাফল্য হিসাবে বিবেচিত জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ শিক্ষার্থী। গত বছর ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন জিপিএ-৫ পেয়েছিল।

মাধ্যমিকের এই পরীক্ষার্থীরা ২০২০ সালে নবম শ্রেণিতে লেখাপড়া শুরুর মাত্র আড়াই মাসের মাথায় করোনার কারণে তাদের সরাসরি ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। ২০২১ সালে দশম শ্রেণি শেষ করা পর্যন্ত সরাসরি ক্লাস করার সুযোগ তারা খুব কমই পেয়েছে। অনলাইন আর অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক লেখাপড়াই ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। এরপরও তারা স্বাভাবিক সময় বা ২০১৯ ও ২০২০ সালের পরীক্ষার্থীদের চেয়ে এই ব্যাচটির পাশের হার বেশি। ২০১৯ সালে পাশের হার ছিল ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ আর ২০২০ সালে ছিল ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। শুধু পাশের হার নয়, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যার তুলনায়ও এবার ভালো করেছে এই ব্যাচটি। ২০২০ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন আর ২০১৯ সালে ১ লাখ ৫ হাজার ৫৯৪ জন। অর্থাৎ গত বছর বা ৩ বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করা শিক্ষার্থীদের তুলনায় পাশের হার কম হলেও আগের ৪ বছরের মধ্যে এবার পাশের হার সর্বোচ্চ। আর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অতীতের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

এগারোটি শিক্ষা বোর্ডের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নেপথ্যে মোটা দাগে পাঁচটি দিক ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। এগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস। এছাড়া আছে-প্রশ্নপত্রে অধিকসংখ্যক বিকল্প থেকে পছন্দের সুযোগ, ৫০-এর মধ্যে দেওয়া পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর ১০০-তে রূপান্তর, কঠিন বিষয়ে অবলীলায় ৯০ শতাংশের ওপরে নম্বর প্রাপ্তি এবং সাবজেক্ট ম্যাপিং।

গত বছরও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। বাংলা-ইংরেজি-গণিতের মতো বিষয় বাদ দিয়ে কেবল বিজ্ঞান, বিজনেস স্টাডিজ আর মানবিকের ঐচ্ছিক তিন বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু এবার সংক্ষিপ্ত ঐচ্ছিক বিষয়ের সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, চতুর্থ বিষয়সহ (কৃষি শিক্ষা, উচ্চতর গণিত, জীববিদ্যা ইত্যাদি) নয়টি পত্রের পরীক্ষা নেওয়া হয়। গত বছর বাকি ৯ বিষয়ে ‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’ বা জেএসসি-জেডিসিতে প্রাপ্ত নম্বর প্রাপ্তির প্রবণতা অনুযায়ী নম্বর দেওয়া হয়।

কিন্তু এবার এই সুযোগ দেওয়া হয় মাত্র তিন বিষয়ে। এগুলো হচ্ছে-বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়/সাধারণ বিজ্ঞান, ধর্ম ও নৈতিকতা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। আবার সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বিষয়টি। এই ব্যাচকে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার বিকল্প সংখ্যাও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। স্বাভাবিক সময়ে সৃজনশীল অংশে ১১টি প্রশ্নের মধ্য থেকে ৭টির উত্তর করতে হতো। এবার ১১টি প্রশ্নই ছিল। কিন্তু উত্তর করতে হয়েছে ৩টি প্রশ্নের। আবার এমসিকিউ অংশে ৩০টির মধ্যে সব ক’টির উত্তর দিতে হতো। কিন্তু এবার ১৫টির উত্তর করতে হয়েছে। এছাড়া তারা ৫০ নম্বরে পরীক্ষা দিলেও সেটিকে ১০০ ধরে প্রাপ্ত নম্বর দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়। ফলে তুলনামূলক চাপমুক্ত থেকে পরীক্ষা দিতে পেরেছে তারা।

অন্যদিকে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের কাছে ইংরেজি-গণিতের মতো বিষয় ‘কঠিন’ হিসেবে বিবেচিত। এসব বিষয়ে এবার শিক্ষার্থীরা ভালো করেছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিষয়ভিত্তিক পাশের হারে দেখা যায়, ইংরেজিতে ৯৬ দশমিক ৬৫ এবং সাধারণ গণিতে ৯৪.৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করেছে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চতর গণিতে ৯৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ, মানবিকে অর্থনীতিতে ৯৭ দশমিক ৪৫ আর বিজনেস স্টাডিজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হিসাববিজ্ঞানে ৯৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ পাশ করেছে। এবার যে তিন বিষয়কে ‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’র আওতায় নেওয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কঠিন বিষয়গুলোর একটি। যেহেতু এটিতে পরীক্ষায় বসতে হয়নি, তাই পাশের হার এবং জিপিএ-৫ এ ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

প্রসঙ্গত, করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার কোনো টেস্ট পরীক্ষা ছাড়াই সবাইকে ফরম পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়। সাধারণত টেস্ট বা নির্বাচনি পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণরা কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে না। তাই যারা কৃতকার্য হতে পারেনি, নির্বাচনি পরীক্ষা হলে তাদের একটি অংশ ঝরে পড়ত। এমন অবস্থায় পাশের হার আরও বৃদ্ধি পেত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এরপরও যে ফল হয়েছে, সেটা নিয়ে খুশি না থেকে মফস্বল বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার মান ভালো করার দিকে মনোযোগ দিতে পরামর্শ দেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক। তিনি বলেন, আগের কোনো পরীক্ষার সঙ্গে এবারের তুলনা করা চলে না। সবমিলে তাদের দুটি বছর অস্বাভাবিক গেছে। আমরা শিক্ষায় কতটা এগিয়েছি বা পিছিয়েছি সেই বিশ্লেষণের পরিবর্তে গ্রাম-শহরের লেখাপড়ার মানের পার্থক্য কমিয়ে আনা জরুরি। এতে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সহজ হবে।

সোমবার বেলা ১১টার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ফলের সারসংক্ষেপ হস্তান্তরের মাধ্যমে এসএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরে বেলা দেড়টার দিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ফল প্রকাশের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এরপরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মোবাইল ফোনে এসএমএস ও অনলাইনেও (www.educationboardresults.gov.bd ওয়েবসাইটে) ফল জানা গেছে। গত বছরের তুলনায় এবার পাশের হার কমে যাওয়ার পেছনে করোনার ধকলের পাশাপাশি বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাককে চিহ্নিত করেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, সিলেট ও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় আকস্মিক বন্যার কারণে পরীক্ষা পেছাতে হয়েছে। ওইসব অঞ্চলের পরীক্ষার্থীদের কেউ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আবার কাউকে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকতে হয়েছে। অনেকের বই বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এর প্রভাবই দেখা যায় সিলেট বোর্ডের পাশের হারে। দেশের সর্বনিু পাশের হার ওই বোর্ডে। তবে এরপরও পাশের হার অন্যান্য বছরের তুলনায় ভালো হওয়ার কারণ হচ্ছে, সরকারি উদ্যোগ এবং শিক্ষক-অভিভাবকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা। ছাত্রছাত্রীরাও জীবনের প্রথম পরীক্ষায় ভালো করার চেষ্টা করেছে।

সোমবার একযোগে ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ করা হয়। এসব বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ৩৪ হাজার ১৮ জন। কিন্তু পরীক্ষায় অংশ নেয় ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন। আর পাশ করেছে ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬১৯ জন। তাদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ শিক্ষার্থী। তিন ধারার মধ্যে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে শুধু এসএসসিতে পরীক্ষার্থী ছিল ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬৫৭ জন। পাশ করেছে ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৫৭১ জন। মাদ্রাসায় পরীক্ষার্থী ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার ১৩২ জন, যাদের মধ্যে ২ লাখ ১৩ হাজার ৮৮৩ জন। আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল পরীক্ষার্থী ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৪৮ জন।

তাদের মধ্যে ১ লাখ ৩০ হাজার ১৬৫ জন পাশ করেছে। আরও দেখা যাচ্ছে, এসএসসিতে ৯টি শিক্ষা বোর্ডে মোট পাশের হার ৮৮ দশমিক ১০ শতাংশ। গত বছর পাশ করেছিল ৯৪ দশমিক ০৮ শতাংশ। মাদ্রাসায় দাখিলে এবার পাশ করেছে ৮২ দশমিক ২২ শতাংশ। গত বছর পাশ করেছিল ৯৩ দশমিক ৩২। আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালে পাশ করেছে ৮৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

গত বছর ৮৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ পাশ করেছিল। অন্যদিকে এবার এই স্তরে তিন ধারায় জিপিএ-৫ বেড়েছে ৮৬ হাজার ২৬২টি। এ বছর মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। আর গত বছর পেয়েছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ শিক্ষার্থী। মাদ্রাসায় এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৫ হাজার ৪৫৭ জন আর কারিগরিতে ১৮ হাজার ৬৫৫ জন। জিপিএ-৫ এসএসসি ও সমমানে সর্বোচ্চ সাফল্য হিসাবে বিবেচিত করা হয়।

এসএসসিতে আলাদাভাবে ৯ বোর্ডের দিকে তাকালে দেখা যায়, ঢাকা বোর্ডে পাশের হার ৯০.০৩ শতাংশ। এই বোর্ডে পরীক্ষার্থী ছিল ৩৯৩৯২৬ জন আর পাশ করেছে ৩৫৪৬৫৩ জন। রাজশাহী বোর্ডে পাশ করেছে ৮৫.৮৮ শতাংশ। পরীক্ষার্থী ছিল ১৯৫১২৪, পাশ করেছে ১৬৭৫৮১ জন। কুমিল্লা বোর্ডে পাশের হার ৯১.২৮ শতাংশ। মোট ১৮৬৭৭৫ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ১৭০৪৮৪ জন। যশোর বোর্ডে পাশের হার ৯৫.১৭ শতাংশ। ১৬৯৫০১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ১৬১৩১৪ জন। চট্টগ্রাম বোর্ডে পাশের হার ৮৭.৫৩ শতাংশ। ১৪৮৫৪০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ১৩০০১৩ জন। বরিশালে পাশের হার ৮৯.৬১ শতাংশ। ৯৪৮৭১ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ৮৫০১৪ জন। সিলেট বোর্ডে ৭৮.৮২ শতাংশ পাশ করেছে।

১১৫৩৯১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ৯০৯৪৮ জন। দিনাজপুর বোর্ডে ৮১.১৬ শতাংশ পাশের হার। পরীক্ষার্থী ছিল ১৭৪৫৭৭ জন। আর পাশ করেছে ১৪১৬৮২ জন। ময়মনসিংহ বোর্ডে পাশের হার ৮৯.০২ শতাংশ। ১০৯৯৫২ জনের মধ্যে পাশ করেছে ৯৭৮৮২ জন। মাদ্রাসায় দাখিলে পাশের হার ৮২.২২ শতাংশ। ২৬০১৩২ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ২১৩৮৮৩ জন। আর কারিগরি বোর্ডে পাশের হার ৮৯.৫৫ শতাংশ। ১৪৫৩৪৮ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ১৩০১৬৫ জন।