হঠাৎ করেই বিশ্বের বড় বড় টেক কোম্পানিগুলো কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে মেটা, টুইটার, অ্যাপল ও মাইক্রোসফটের মতো জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান। একই পথে হাঁটা শুরু করেছে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী অনলাইন মার্কেট প্লেস অ্যামাজনও। তারা অন্তত ১০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। গুঞ্জন উঠেছে আরেক জায়ান্ট কোম্পানি অ্যাপলও নাকি কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে দ্রুতগতিতে কর্মী ছাঁটাইয়ের বিপরীতে নতুন কর্মী নিয়োগ হচ্ছে ধীরে-সুস্থে। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন কর্মী নিয়োগের মন্থর গতি শুরু হয়েছিল কোভিড-১৯ মহামারির শুরুর দিকেই। তবে কোভিড-পরবর্তী সময়ে কোম্পানিগুলো নতুন কর্মী নিয়োগের চেয়ে ব্যয় কমিয়ে অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে চেয়েছে। মূলত তারই ফলস্বরূপ কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটছে এসব কোম্পানি। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে চাকরির বাজারে। সদ্য পাস করা ডিগ্রিধারী বেকারের সঙ্গে যোগ হচ্ছে চাকরিচ্যুত দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মী। এই সংখ্যা যত বাড়বে, চাকরির বাজার ততই অস্থিতিশীল হবে।
চাকরি যাচ্ছে অ্যামাজনের ১০ হাজার কর্মীর, কিন্তু কেন?
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যামাজন শিগগিরই কর্মী ছাঁটাই করতে যাচ্ছে। যার সংখ্যাটা ১০ হাজার পর্যন্ত হতে পারে। অ্যামাজনের ঘোষণাটি এমন সময় এসেছে যখন আমেরিকায় ব্ল্যাক ফ্রাইডে (সবচেয়ে বড় বিক্রি উৎসব) শুরু হওয়ার কয়েকদিন বাকি আছে।
ঘোষণা অনুসারে অ্যামাজন যদি এই পরিমাণ কর্মী ছাঁটাই করে, তবে সেটা হবে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ছাঁটাইয়ের ঘটনা। এ নিয়ে সম্প্রতি ব্লুমবার্গ একটি প্রতিবেদন করে। সেখানে বলা হয়, ব্যয় সংকোচন নীতির ফলে অ্যামাজন তাদের বহু কর্মীকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছে। এছাড়া মহামারির মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি মানুষের পরিবর্তে ডেলিভারির কাজে রোবট ব্যবহার করেছে। এতে সফলতা পাওয়ায় ডেলিভারির কাজে নিয়োজিত প্রায় ৪০০ কর্মীকে ইতোমধ্যেই সরিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে অ্যামাজনের পক্ষ থেকে এখনো নিশ্চিত করে বলা হয়নি কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়া শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই চলবে নাকি অন্যান্য দেশেও এর প্রভাব পড়বে। বর্তমানে অ্যামাজনে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ কাজ করছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, দুর্বল অর্থনীতির বিষয়টি বিবেচনায় আনলে কর্মী ছাঁটাই আশ্চর্যজনক নয়। যদি কেউ অ্যামাজনের তৃতীয়-প্রান্তিকের ব্যালেন্স শিটের দিকে নজর দেয়, দেখা যাবে নিট বিক্রয় ১৫ শতাংশ বেড়ে ১২৭.১ বিলিয়ন হয়েছে। কিন্তু এর অপারেটিং আয় গত বছরের একই ত্রৈমাসিকের ৪.৯ বিলিয়নের তুলনায় ২.৫ বিলিয়নে নেমেছে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল অনুসারে, অ্যামাজনের আয় প্রত্যাশার চেয়ে ২-৪ শতাংশ কমেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে কিছুটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
মেটা থেকে চাকরি যাচ্ছে ১৩ শতাংশ কর্মীর
বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মূল প্রতিষ্ঠান মেটাও কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ৯ নভেম্বর জানিয়েছে প্রায় ১১ হাজার লোকবল ছাঁটাইয়ের জন্য প্রস্তুত তারা। যা প্রতিষ্ঠানটির মোট জনবলের ১৩ শতাংশ।
এ নিয়ে অবশ্য কথা বলেছেন মেটা প্রধান মার্ক জাকারবার্গ। তিনি বলেন, মহামারির পরে অন্যসব প্রতিষ্ঠানের মতো আমরাও বিনিয়োগ বাড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবে হচ্ছে না।
বছরের শেষ প্রান্তিকে এসে প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞাপন থেকে বড়সড় আয় কমেছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এক বছরের ব্যবধানে মেটার নিট আয় ৫২ শতাংশ কমে মাত্র ৯১.৪ বিলিয়ন থেকে ৪৩.৫ বিলিয়ন হয়েছে।
ফলে মেটার অধীনে পরিচালিত ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ও ভিআর ডিভিশনের কর্মীদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যদিও প্রতিষ্ঠানটি কথা দিয়েছে, ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের তারা ১৬ সপ্তাহের বেতন প্রদান করবে। একইসঙ্গে কর্মীদের স্বাস্থ্য বিমার অর্থ প্রদান করা হবে।
এক ব্লগ পোস্টে মার্ক জাকারবার্গ বলেন, আমি বিশ্বাস করি আমরা যদি আরও কঠোর পরিশ্রম করতে পারি, তাহলে আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসতে পারব।
বেশিরভাগ কর্মীরই চাকরি নেই টুইটারে
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনকুবের ইলন মাস্ক টুইটারের মালিকানা গ্রহণ করার পরই কর্মী ছাঁটাই শুরু করেন। প্রথমে প্রতিষ্ঠানটির সিইও ও ইএফওকে ছাঁটাই করেন এই ধনকুবের। ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ৪৪০০-৫৫০০ কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। মাস্ক অবশ্য বলেছেন, একটি কোম্পানি দৈনিক ৪ মিলিয়ন ইউএস ডলার লোকসান গুনছে, সেখানে কর্মী ছাঁটাই ছাড়া আর কোনো উপায় তো নেই।
গত মাসের শেষের দিকে ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে টুইটার কিনে নেন ইলন মাস্ক। এরপর বিশ্বব্যাপী সংস্থাটির অর্ধেক কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়। ভারতে ৯০ শতাংশ কর্মীকে বরখাস্ত করেছে টুইটার। আর তাই আগামী দিনগুলো সোশ্যাল মিডিয়ার এই সংস্থাটির কর্মচারীদের জন্য কঠিন হতে পারে বলেই মনে করছেন অনেকে।
চাকরি যেতে পারে মাইক্রোসফট, অ্যাপল ও গুগল কর্মীদেরও
এক্সিওসের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রায় ১ হাজার কর্মীকে ছাঁটাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে মাইক্রোসফট। এসব কর্মী প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় থেকে (ওয়ার্ক ফ্রম হোম) কাজ করছেন। তবে এ নিয়ে এখনো স্পষ্ট কিছু বলেনি মাইক্রোসফট। ধারণা করা হচ্ছে, শিগগিরই প্রতিষ্ঠানটির তরফ থেকে ছাঁটাইয়ের ঘোষণা আসতে পারে।
এছাড়া বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে গুগল তাদের কর্মী ছাঁটাইয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি নতুন নিয়োগ অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে।
এদিকে অ্যাপলও ছাঁটায়ের ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সিইও টম কুক ইতোমধ্যে বলেছেন, নতুন কোনো নিয়োগের দিকে আপাতত যাচ্ছে না তারা। একইসঙ্গে কিছু কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
মূলত নানাবিধ বৈশ্বিক সংকট, প্রযুক্তি খাতে রাজনৈতিক প্রভাব, লাভ কমে যাওয়া ও ব্যয় সংকোচন নীতির ফলে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের ছাঁটাই করছে।
সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস