Logo
Logo
×

জাতীয়

ছোট হয়ে আসছে বাংলাদেশিদের পৃথিবী

ভিসা পাচ্ছেন না নাগরিকরা : সংকটে পাসপোর্টে আস্থা

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:২০ পিএম

ছোট হয়ে আসছে বাংলাদেশিদের পৃথিবী

বিশ্বের দরজা বাংলাদেশিদের জন্য যেন ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। একসময় যেখানে বিদেশ ভ্রমণ বা কর্মসংস্থানের উদ্দেশে দেশ ছাড়ার সুযোগ ছিল তুলনামূলক সহজ, এখন প্রতিটি পদক্ষেপে জটিলতা, সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা। বিশ্বের নানা প্রান্তে একের পর এক ভিসা নিষেধাজ্ঞা, বাংলাদেশি ফেরত, প্রশাসনিক জটিলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশের পাসপোর্ট হারিয়েছে আন্তর্জাতিক আস্থা।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স প্রকাশিত ২০২৫ সালের হেনলি পাসপোর্ট সূচকে বাংলাদেশ ১০৬ দেশের মধ্যে ১০০তম অবস্থানে অর্থাৎ বিশ্বের সপ্তম দুর্বলতম পাসপোর্ট। এই সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানে রয়েছে উত্তর কোরিয়া, এমনকি যুদ্ধপীড়িত ফিলিস্তিন রয়েছে আরও এক ধাপ ওপরে, ৯৯তম স্থানে। মাত্র ৩৮টি দেশে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার থাকলেও, সেখানেও জিজ্ঞাসাবাদ, সীমান্তে বাধা ও সন্দেহের মুখে পড়ছেন বাংলাদেশিরা। এ যেন এক ভয়াবহ সংকট, যেখানে নাগরিক পরিচয়ই পরিণত হয়েছে অবিশ্বাসের প্রতীকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশাসনিক দুর্বলতা, মানবপাচার ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এ অবনতি ঘটেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরপরই নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ভারত বাংলাদেশজুড়ে তাদের ভিসাকেন্দ্রগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়। যদিও পরে সীমিত পরিসরে চিকিৎসা ও শিক্ষার্থী ভিসা চালু করা হয়।

শ্রীলংকায় ভ্রমণে যেতে এখন বাধ্যতামূলক হয়েছে ‘ইলেকট্রনিক ট্রাভেল অথরাইজেশন’ (ইটিএ)। অন্যদিকে ২০২৫ সালের মে থেকে সৌদি আরব বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের কর্ম ভিসা সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। ডেনমার্ক ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশÑ মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম ভিসা প্রক্রিয়া কঠোর করেছে।

ভ্রমণকারীরা জানাচ্ছেন, এখন ভিসা পেতে সময় লাগছে বেশি, বাতিলের হার বেড়েছে এবং বৈধ ভিসা নিয়েও ইমিগ্রেশনে ‘অফলোড’ হওয়ার ঘটনা ঘটছে। বিদেশ থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর ঘটনাও পাসপোর্ট সংকটকে আরও তীব্র করেছে।

২০২৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কিরগিজস্তান ফেরত পাঠায় ১৮০ অনিবন্ধিত বাংলাদেশিকে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ফেরত পাঠায় ৩০ জনকে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তত ১৮৭ জনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হয়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ইতালি, অস্ট্রিয়া, গ্রিস ও সাইপ্রাস থেকেও ফেরত পাঠানো হয় ৫২ বাংলাদেশিকে। আগস্টে যুক্তরাজ্য ফেরত পাঠায় ১৫ জন এবং মালয়েশিয়া ৯৮ জন বাংলাদেশিকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মানবপাচার ও অনিয়মিত অভিবাসনের প্রবণতা বাংলাদেশের পাসপোর্টের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ‘ট্রাফিকিং ইন পারসন্স (টিআইপি) রিপোর্ট ২০২৫’-এ বলা হয়েছে, বৈশ্বিক মানবপাচারে বাংলাদেশ টায়ার-২ অবস্থানে রয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত এক বছরে ৩ হাজার ৪১০ জন পাচারের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে যৌন পাচারের শিকার ৭৬৫ জন, জোরপূর্বক শ্রমে ২ হাজার ৫৭২ জন এবং অন্য ধরনের পাচারে ৭৩ জন। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত এক বছরে ১ হাজার ৪৬২ পাচারের শিকার ব্যক্তিকে শনাক্ত করা গেছে।

২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সম্প্রতি ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমি সম্প্রতি কয়েকটি দেশ সফর করেছি। বর্তমানে লাল পাসপোর্ট থাকার কারণে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি। তারপরও বাংলাদেশি হওয়ায় বারবার বাঁকা চোখে দেখেছে। আমি যখন সবুজ পাসপোর্ট ব্যবহার করি, তখন বাংলাদেশি দেখে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি।’

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশিদের হেনস্তার জন্য শুধু বিদেশিরা নয়, আমরাও দায়ী। আমাদের নিজেদের নথিপত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে।

ভ্রমণকারীরা বলছেন, এখন ভিসা পেতে সময় লাগছে দ্বিগুণ, বাতিলের হার বেড়েছে এবং বৈধ ভিসা নিয়েও ইমিগ্রেশনে ‘অফলোড’ হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। বিদেশে অনিয়মিত অবস্থান ও ফেরত পাঠানোর ঘটনাও বেড়েছে।

শিক্ষার্থী, পর্যটক, এমনকি চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ভ্রমণকারীরাও ভিসা জটিলতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। শিক্ষার্থী ভিসা নিয়ে কাজ করা এজেন্সিগুলোর মতে, যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা রিজেকশনের হার এখন অনেক বেড়েছে। আগে যেখানে শত আবেদনকারীর মধ্যে ৩০ শতাংশের বেশি ভিসা পেতেন, এখন তা অনেক কমে গেছে। ইউরোপের দেশগুলোও ভিসা সিদ্ধান্তে সময় নিচ্ছে দীর্ঘ, বিশেষ করে যেখানে বাংলাদেশে দূতাবাস নেই, সেখানে আবেদনকারীদের তৃতীয় দেশে গিয়ে আবেদন করতে হচ্ছে যা ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ।

পর্যটক ভিসার ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। একাধিক ট্রাভেল এজেন্সি বলছে, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো জনপ্রিয় গন্তব্যগুলোয়ও বাংলাদেশিদের ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এক এজেন্সি কর্মকর্তা বলেন, ‘থাইল্যান্ডে গিয়ে অনেকেই লাওস বা কম্বোডিয়া চলে গেছে। ফলে দেশগুলো এখন কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।’

শ্রমবাজারেও দেখা দিয়েছে সংকট। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘যারা অবৈধ পথে যাচ্ছেন, তাদের জন্য বৈধ প্রক্রিয়ার লোকরাই বাধার মুখে পড়ছেন। এখন সময় এসেছে দক্ষ কর্মী তৈরি ও অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেওয়ার।’

বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রশাসনিক দুর্বলতা, মানবপাচার এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশের পাসপোর্টের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থা পুনরুদ্ধার না হলে ভিসা সংকট আরও গভীর হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার