কামরুজ্জামান কামরুজ্জামান, ওসমান গনিদের ‘সুইজারল্যান্ড প্রবাসী’র নেপথ্যে আসলে কারা?
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩৭ পিএম
কামরুজ্জামান কামরুজ্জামান, ওসমান গণি, আবুল কালাম প্লাম্বার নামগুলো গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের কাছে বেশ পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
ফেসবুক ভিত্তিক স্যাটায়ার বা ব্যাঙ্গাত্মক পাতা ‘সুইজারল্যান্ড প্রবাসী’র চরিত্র এরা।
সেই পাতার তথ্য অনুযায়ী, এরা সবাই সুইজারল্যান্ডে প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটি সমিতির সদস্য। তাদের একটি ফেসবুক পাতার নাম 'সুইজারল্যান্ড প্রবাসী', যে পাতায় সবাই নিজেদের মতো করে মন্তব্য করেন, চিন্তাভাবনার প্রকাশ করেন। তার মাধ্যমে সদস্যদের নিজেদের চিন্তাভাবনা, পরশ্রীকাতরতা, হীনমন্যতা, আচরণ বেরিয়ে আসে।
এই পাতাটি চালু হওয়ার দুই বছরের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে এই পাতার দুই লাখ ৮০ হাজার ফলোয়ার রয়েছে। কামরুজ্জামান কামরুজ্জামান, ওসমান গনির মতো চরিত্রদেরও আলাদা আলাদা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। পাতাটির পরিচয় অংশে লেখা আছে, 'মাতৃভূমি সুইজারল্যান্ডকে ভালোবাসি । হৃদয়ে সুইজারল্যান্ড'।
অনেকের জানা নেই, সুইজারল্যান্ড প্রবাসী নামে পরিচিত হলেও এই পাতাটি আসলে সুইজারল্যান্ড থেকে পরিচালিত হয় না, সেখানকার কেউ পাতাটির সাথেও নেই।
এই পাতাটির পেছনে রয়েছেন প্রবাসী একজন বাংলাদেশি ও তার দল। তিনি নিজের বা দলের সদস্যদের নাম প্রকাশ করতে চাননি। পাঠকদের সুবির্ধার্থে আমরা তাকে ‘সুইজারল্যান্ড প্রবাসী’ বা কখনো কখনো শুধুমাত্র ‘প্রবাসী’ বলে বর্ণনা করবো।
সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পাতার এই নির্মাতা বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, এই পাতার সবাই কাল্পনিক চরিত্র হলেও তারা আসলে প্রবাসে থাকা বিভিন্ন বাংলাদেশি চরিত্রের আদলে তৈরি করা হয়েছে, যাদেরকে প্রবাস জীবনের নানা পর্যায়ে তিনি দেখতে পেয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি আসলে যে দেশে থাকি, এখানে আমার আশেপাশে যে মানুষজন, তাদের মধ্যে সুইজারল্যান্ড প্রবাসীর ক্যারেক্টারগুলোর অনেক মিল আছে। যেমন ধরুন আমি যদি একজন স্টুডেন্ট হই, তারা আমাকে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করবে। বলবে অমুকের সাথে মেশা যাবে না, অমুকের কাছে যাওয়া যাবে না।’
‘এখানে আবার গ্রুপও আছে। কেউ সিলেট থেকে আসা সিলেটি কম্যুনিটি, কেউ ইটালি থেকে আসা বা কেউ পর্তুগাল থেকে আসা, এক গ্রুপের সাথে আরেক গ্রুপের ঝামেলা। এটা সবাই যে করে তা না, বেশিরভাগ এরকম করে।’
‘আমার মনে হলো, এই যে চরিত্রগুলো, প্রবাস জীবনের যে অভিজ্ঞতাগুলো, সেটা তুলে নিয়ে আসি, মানুষকে জানাই। দেখা গেল, এই ঘটনাগুলো আসলে কমবেশি সবার সাথেই হচ্ছে। এই পরিবেশের কারণে অনেকে বাঙালিদের এড়িয়ে চলে। ওই চিন্তাচেতনাটাই আমাদের পেজে তুলে ধরি।’
তিনি জানান, বিদেশে আসার পর বাংলাদেশি মালিকের একটি রেস্তোরায় কাজ নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘সেটার মালিক ছিলেন এই ওসমান গনির মতো। উনি আমার স্যালারি দেবেন না, দুই মাস পরে দেবেন, আমার উপর অকারণে কঠিন কঠিন কাজ চাপিয়ে দেবেন- এরকম নানা ঘটনা ঘটত। আমি একটা ইন্ডিয়ান রেস্তোরায় কাজ করতাম, সেটার মালিক ছিলেন বাংলাদেশি। সেখানে আমি অনেক রকমের বিরূপ আচরণ পেয়েছি, যা কামরুজ্জামানের সাথে করা হয়, ওসমান গনি সেটা করে। বাস্তব জীবনের এসব অভিজ্ঞতাই সুইজারল্যান্ড প্রবাসীর পাতায় তুলে ধরা হয়।’
সুইজারল্যান্ড প্রবাসী বলছিলেন, তিনি যখন যুক্তরাজ্যে আসেন, তখন একটি স্কলারশিপে আসা তার স্ত্রীর স্পাউস হিসেবে এসেছিলেন।
এই স্পাউস হিসেবে আসার জন্য সেখানকার বাংলাদেশি কম্যুনিটির মধ্যে তাকে অনেক কথা শুনতে হয়। অনেকে বলতো, এই লোকটা স্ত্রীর সাথে এসেছে, তার হয়তো দেশে কিছু নাই। কিন্তু আমি যে স্ত্রীকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে গেছি, সেটা কেউ অ্যাপ্রিসিয়েট করেনা।
কামরুজ্জামান কামরুজ্জামানের ঠিকানা কোথায়?
অদ্ভূত সব কর্মকাণ্ডের জন্য পাঠকদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত হয়ে উঠেছেন কামরুজ্জামান কামরুজ্জামান, ওসমান গণি, আবুল কালামের মতো চরিত্রগুলো। তারা কি বাস্তব জীবনে আসলেই আছেন?
জানতে চাইলে সুইজারল্যান্ড প্রবাসী জানান, সরাসরি না হলেও এই ধরনের চরিত্র বর্তমানেও আছে। নামটা হয়তো ভিন্ন, ছবিগুলোও হয়তো মডিফাই করা, কিন্তু এ ধরনের মানুষ প্রত্যেকেই তাদের আশেপাশে আছে।
তিনি বলেন, ‘যারা ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করছেন, কবিতা লিখছেন বা নারী বিদ্বেষী কথাবার্তা বলছেন, এরা প্রত্যেকেই আছে আমাদের আশেপাশে।’
কিন্তু পাতাটির সাথে যারা সংশ্লিষ্ট, তারা কেউ দেশবিরোধী, সাম্প্রদায়িক বা নারী বিদ্বেষী নন। শুধু তারা এই ধরনের মানুষদের মানসিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
এই পাতায় কামরুজ্জামান কামরুজ্জামান বা ওসমান গনিসহ যাদের ছবি ব্যবহার করা হয়, তারা পাতার অ্যাডমিনদের পরিচিত ব্যক্তি। তাদের অনুমতি নিয়েই এসব ছবি ব্যবহার করা হয়। তবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই ব্যবহার করে এসব ছবিতে পরিবর্তন করা হয়। ফলে বাস্তবের সেই ব্যক্তির সাথে পুরোপুরি মেলানো যাবে না।
যেভাবে তৈরি হয়েছিল ‘সুইজারল্যান্ড প্রবাসী’
সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পাতাটি শুরু হয়েছিল যুক্তরাজ্যের একটি বাসায়। তারা স্বামী-স্ত্রী সারাদিন কাজ শেষে ঘরে ফিরে নানা বিষয় নিয়ে গল্প করতেন। সেসব গল্প থেকেই প্রথম তাদের পাতাটির কনটেন্ট তৈরি শুরু হয়।
সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পাতার মূল অ্যাডমিন বসবাস করেন যুক্তরাজ্যে। তবে তার দলের আরো একজন রয়েছেন যুক্তরাজ্যে, দুইজন বাস করেন যুক্তরাষ্ট্রে ও একজন সুইডেনে। তারা অনলাইনে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কনটেন্ট ঠিক করেন, মডারেট করেন বা পাতাটি পরিচালনা করেন। আরো কয়েকজন মডারেটর রয়েছেন যারা পাতাটি পরিচালনায় সহায়তা করে থাকেন।
কিন্তু বাংলাদেশিরা তো বিশ্বের অনেক দেশেই বসবাস করেন। তাহলে এই পাতাটির নাম যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা যুক্তরাজ্য প্রবাসী না হয়ে সুইজারল্যান্ড প্রবাসী কেন হলো?
এর পেছনে তিনি নিজের জীবনের একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগে আমি ও কয়েকজন বন্ধু মিলে সুইজারল্যান্ড বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেই সময় সেখানকার কিছু বাজে অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। আমার সেই পোস্টে এসে অসংখ্য মানুষ, অ্যাকচুয়াল সুইজারল্যান্ড প্রবাসীরা দলবেধে এসে আমাকে গালাগাল করতে থাকে যে, আপনি সুইজারল্যান্ডে আসার যোগ্য না। সব কিছু দামী জানার পরেও কেন এসেছেন, ব্যাকপ্যাকারদের জন্য সুইজারল্যান্ড না। তখন আমাদের মনে হলো, এই মানুষগুলোকে আমরা মিউজিয়ামে রাখি। নিছক মজা করার জন্য পেজটা করা, কিন্তু সেটা যে মানুষের মনে এতটা জায়গা করে নেবে, সেটা বুঝতে পারিনি।’
যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আগে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পাতার মূল উদ্যোক্তা। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন সেলিব্রেটির ফেসবুক পাতা তারা পরিচালনা করেছেন। এর আগেও আরো কয়েকটি জনপ্রিয় ফেসবুক পাতা তারা তৈরি করেছিলেন, যদিও সেগুলোর নাম প্রকাশ করতে চাননি।
বর্তমানে এই পাতার জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিদেশি দূতাবাসও তাদের বিশেষ ঘোষণায় কামরুজ্জামান কামরুজ্জামানের ছবি ব্যবহার করেছে।
এই পাতার কনটেন্ট তৈরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিনে বসে আমরা আলাপ আলোচনা করি, কী পোস্ট করবো, দেশে কি ঘটছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে পোস্ট ঠিক করি।’
সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পাতায় দেখা যায়, প্রবাসী বাংলাদেশি হলেও বাংলাদেশিদের নিয়ে, বাংলাদেশ নিয়ে চরিত্রগুলোর মধ্যে একটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য থাকে। ওসমান গনির মতো চরিত্রগুলো সুইজারল্যান্ডকেই মাতৃভূমি বলে মনে করে।
‘এটা আমরা দেখছি, দেখতে দেখতে এত অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কারণ এখানে যারা আসেন, যারা থাকেন, সবাই দেশের বদনাম করতে থাকেন। যারা দীর্ঘদিন ধরে এদেশে থাকেন, তারা তো দেশকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা ছাড়া, দেশকে নিয়ে বাজে কথা বলা ছাড়া কিছুই শুনিনা আমরা। যারা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে আবেদন করেন, তারা দেশকে নিয়ে সবসময়ে বাজে কথা বলেন। সবাই না, কিন্তু অনেকে এভাবে চিন্তা করেন।’
তিনি বলেন, ‘অনেকে মনে করতে পারে, এসব পোস্টের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশিদের ছোট করি। আসলে কিন্তু তা নয়। বরং যে বাংলাদেশিরা অন্য বাংলাদেশিদের ছোট করে, দেশকে ছোট করে, তাদের চেহারা তুলে ধরি।’
সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পাতার এই উদ্যোক্তা নিজে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত অন্য একটি চাকরি করেন। আরো যারা পাতার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, তাদের কেউ চাকরি করেন, কেউ পিএইচডি করছেন, কেউ হোমমেকার। তাদের নিজেদের কাজের পাশাপাশি সবাই এই পাতার পেছনে সময় দেন।
হঠাৎ কেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল?
সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পাতাটি তৈরি করা হয় ২০২৩ সালের জুলাই-আগস্টের দিকে। জনপ্রিয় হয়ে উঠার কিছুদিন পরে একটি ঘোষণা দিয়ে পাতাটির কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর আবার অনেকটা হঠাৎ করে আবার চালু হয় ২০২৪ সালের অগাস্ট মাসের শুরুতে। এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ কি আর আবার চালুই বা হলো কেন?
সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পাতার এই কারিগর বলছেন, ‘আমি এরকম অনেক পেজই করেছিলাম, যেগুলো নির্দিষ্ট সময় পরে বন্ধ করে দিয়েছিলাম, যাতে মানুষ সেটা মনে রাখে। এভাবেই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে আবার ফিরে আসলাম কেন? ওই আমি চলে যাবো, এরকম একটি পোস্ট দিয়ে বন্ধ করে দির্য়েছিলাম, সেখানে প্রতিদিনই কমেন্ট আসতেই থাকতো। এই যে ভালোবাসাটা, সেটা জুলাই অভ্যুত্থানের সময়, যখন প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে দেয়-তখন মনে হলো যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের সময় আমাদের থাকা উচিত।’
‘তখন কামরুজ্জামান ক্যারেক্টার থেকে একটা পোস্ট করা হলো যে, আমিও আর ব্যাংকে টাকা পাঠাবো না। সেটা অনেক হিট হলো। এরপর আবার অগাস্টের পাঁচ তারিখে একটা পোস্ট করি। এই যে দেশের মানুষ একটা গণজোয়ার, আনন্দে ভাসছে, আমরাও সেটা সেলিব্রেট করলাম। দেখা গেল, মানুষ আবারো আমাদের গ্রহণ করছে, ভালো লাগছে, তখন আমরা থেকে গেলাম, আর গেলাম না।’
ইদানিং দেখা যাচ্ছে, সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পাতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন আকারে পোস্ট দেখা যাচ্ছে। নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনেকটা মজা করেই এসব পোস্ট দেয়া হয়। এতে কি এই পাতাটির স্যাটায়ার ধর্মী চরিত্রটি কি নষ্ট হয় যাচ্ছে?
এই প্রসঙ্গে প্রবাসী বলছিলেন, তাদের পাতাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পরে বাংলাদেশের কিছু ব্র্যান্ড প্রমোশনের জন্য যোগাযোগ করতে শুরু করে। শুরুতে নিজেদের পরিচিত মানুষজনকে প্রমোশন দিয়ে শুরু হয়। তবে এ ধরনের কোলাবরেশনের ক্ষেত্রে কিছুটা সতর্কতা ও যাচাইবাছাই করা হয়। এভাবে প্রতিদিন ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার মতো বিজ্ঞাপন ফিরিয়ে দিতে হয়।
সুইজারল্যান্ড প্রবাসী জানাচ্ছিলেন, যুক্তরাজ্য, সুইডেন বা যুক্তরাষ্ট্রে বসে তারা পাতাটি পরিচালনা করলেও তাদের আশেপাশের সার্কেলের বা কম্যুনিটির লোকজন জানে না। অনেক সময় তাদের সামনেই লোকজন পাতাটি নিয়ে গল্প করে, হাসাহাসি করে। কিন্তু তারা নিজেদের আড়ালে রাখতেই পছন্দ করেন।