ঋতুস্রাবের (পিরিয়ড) পেট বা কোমরে অসহ্য ব্যথা, ক্লান্তি, মুড সুইং… নানা উপসর্গ লেগেই থাকে। এইরকম সময় কি যৌনতায় লিপ্ত হওয়া উচিত? এই প্রশ্ন অনেকেরই। এই প্রসঙ্গে কী বলছেন চিকিৎসকরা?
আকাশ হেলথ কেয়ারের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শিল্পা ঘোষ এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে এই বিষয়ে বলতে গিয়ে জানাচ্ছেন, “পিরিয়ড চলাকালীন যৌনতা থেকে দূরে থাকার প্রয়োজন নেই। বরং ঋতুস্রাব চলাকালীন সঙ্গমে লিপ্ত হলে তা সুখকর হতে পারে অনেকের ক্ষেত্রেই। এমনকী অন্যান্য সময়ের থেকেও বেশি তৃপ্তি মিলতে পারে। আসলে পিরিয়ড চলাকালীন সেক্স করলে তা ক্র্যাম্পের মতো সমস্যা থেকে রেহাই দিতে পারে।” তাছাড়া এই সময় অর্গ্যাজম হলে শরীরে এন্ডফিন নিঃসৃত হয়। যা আসলে অক্সিটোসিন ও ডোপামিনের মতো মন ভাল রাখার হরমোন। ফলে পিরিয়ডের অবসাদ থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে।
তবে এক্ষেত্রে কিছু সাবধানতাও যে প্রয়োজন তা মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার মতে, এই সময় অবশ্যই ‘সেফ সেক্সে’র দিকে ঝুঁকতে হবে। অন্যথায় যৌন অসুখের সংক্রমণ কিংবা অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের মতো বিপদে পড়তে হবে। তাছাড়া এই সময় যেহেতু যোনিপথ পিচ্ছিল থাকে, তাই আলাদা করে লুব্রিক্যান্ট ব্যবহারেরও প্রয়োজনীয়তা নেই।
কিন্তু আয়ুর্বেদ শাস্ত্র আবার পিরিয়ডের সময় যৌনতাকে ‘বিপজ্জনক’ মনে করছে। কেরলের আয়ুর্বেদ চিকিৎসক অর্চনা সুকুমারানের মতে, এই সময় মহিলাদের বিশ্রামে থাকা উচিত। কেননা মাসিকের ফলে শরীরে ভারসাম্যের অভাব ঘটতে থাকে। তাছাড়া তিনি জানাচ্ছেন, এই সময় যৌনতা করলে তা স্ত্রী প্রজনন ব্যবস্থার ক্ষতিও হতে পারে। আরেক আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ দীক্ষা ভবসরের মতে, যৌনতার সময় শরীরে বায়ুর পরিমাণ বাড়ে। এর ফলে পিরিয়ডের যন্ত্রণা আরও বেড়ে যেতে পারে। তাই এই দিনগুলিতে শরীরী সুখের দিকে না যাওয়াই ভাল।
তবে বিশ্বের অনেক বড় বড় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এসময়ে সহবাস না করার পক্ষেই মত দিয়েছে।
বিবিসির খবরে বলা হয়, আইসিডিডিআরবি'র চালানো ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভেতে বলা হয়েছে, পিরিয়ডের সময়ে পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে প্রায় কোন ধারণাই নাই বেশির ভাগ নারীর।এ সময় কোনোভাবেই একই কাপড় পরিষ্কার করে একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না। পিরিয়ডের সময় শরীর থেকে যে রক্ত প্রবাহিত হয়, তার মধ্যে ব্যাকটেরিয়া থাকে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মাসিকের সময় জরায়ু ও যোনির অম্লভাব থাকে না। তাই এটি খুব সহজেই রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। পিরিয়ডের সময় শারীরিক সম্পর্ক হলে নারীদের জরায়ুতে ইনফেকশন হতে পারে। পিরিয়ড চলাকালীন শরীরিক সম্পর্ক হলে পিরিয়ডের যে রক্ত শরীরের ভেতর থেকে বের হয়, সেটি অন্য কোনো অংশে ঢুকে জমাট বেঁধে যেতে পারে। এতে হতে পারে বিভিন্ন ধরনের রোগ। এছাড়া পিরিয়ডের সময় শারীরিক সম্পর্ক হলে রক্তপাত স্বাভাবিকের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি হতে পারে। তাই পিরিয়ড চলাকালীন শরীরিক সম্পর্ক নয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে পিরিয়ড চলাকালীন শারীরিক সম্পর্ক তথা স্ত্রীর সাথে সহবাস করা হারাম। কবিরা গুনাহ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘লোকে তোমাকে রক্তস্রাব সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। বল, উহা অশুচি। সুতরাং তোমরা রক্তস্রাবকালে স্ত্রী সংগম বর্জন করবে এবং পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী সংগম করিবে না। অতপর তাহারা যখন উত্তম রূপে পরিশুদ্ধ হইবে, তখন তাহাদের নিকট ঠিক সেইভাবে গমন করিবে যেভাবে আল্লাহ তোমাদিগকে আদেশ দিয়েছেন। (সুরা বাকারা:২২২, ইফাবা)
সুতরাং স্বামীর জন্য জায়েয হবে না স্ত্রী সহবাস করা যতক্ষন না স্ত্রী হায়েয থেকে মুক্ত হয়ে গোসল করে পবিত্র হয়। হায়েয অবস্থায় স্ত্রী সহবাস যে একটি গর্হিত ও হারাম কাজ রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হাদিস থেকেও তার প্রমান পাওয়া যায়। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল সা. আমাদের কারো পিরিয়ড অবস্থায় আমাদেরকে স্যালোয়ার পড়ার নির্দেশ দিতেন এরপর আমাদের গায়ে লেগে শুতেন। তোমরা সতর্ক থাকো কেননা কে তোমাদের মধ্যে রাসুলের মতো নিবৃত্ত করতে সক্ষম? (সহিহ বুখারি: ৩০২) রাসুল সা. বলেছেন- ‘যে ব্যাক্তি হায়েয অবস্থায় সহবাস করে বা পিছনের রাস্তা দিয়ে স্ত্রীর সাথে মিলন করে কিংবা কোন গণকের কাছে গমন করে, তবে সে আমার নিকট যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অস্বীকার করল। (তিরমিযী) ভুলে কেউ এ কাজ করলে কোন গুনাহ হবে না তবে তওবা ইসতেগফার করতে হবে আর ইচ্ছাকৃত করলে এক দিনার পরিমান সদকা করা মুস্তাহাব। (ফতোয়া শামি১/৪৯৫ জাকারিয়া, ফতোয়া হিন্দিয়া:১/৩৯) এমনকি স্ত্রীর সন্তুষ্টিতে যদি স্বামী স্ত্রীর সাথে পিরিয়ড অবস্থায় সহবাস করে তাহলে স্ত্রীও গুনাহগার হবে। (মাহমুদিয়া:৮/২২৫) আল-মাজমূ শারহুল মুহায্যাব ২য় খন্ডের ৩৭ নং পৃষ্ঠায় ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, পিরিয়ড চলাকালে যে ব্যক্তি স্ত্রী সঙ্গমে লিপ্ত হবে তার কবীরা গুনাহ হবে।
স্মরণ রাখতে হবে, পিরিয়ড অবস্থায় স্ত্রী সহবাস হারাম হওয়ার ব্যাপারে সমস্ত মুসলমান একমত। এখানে কারো কোন দ্বিমত নেই। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলা এবং পরকালের প্রতি ঈমান রাখে তার জন্য এমন একটি অসৎ কাজকে বৈধ মনে করা কোনভাবেই উচিৎ নয়।