Logo
Logo
×

ইসলাম

ভারতের ইতিহাস বদলে দিয়েছিলেন যে মাওলানা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৭ পিএম

ভারতের ইতিহাস বদলে দিয়েছিলেন যে মাওলানা

মওলবি আশরাফ
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (রহ.) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের এক বিস্ময়-পুরুষ। তার মতো বহুমাত্রিক প্রতিভাধর খুবই কম পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন একই সাথে জাতীয় নেতা, ধর্মীয় চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বক্তা। বিভিন্ন প্রতিভার এক অনন্য সমন্বয় ঘটিছিল তার মধ্যে। যে ক্ষেত্রেই তিনি ভূমিকা রেখেছেন, তাতে সাফল্যের ছাপ রেখেছেন। তার ব্যক্তিত্বে এমন এক পূর্ণতা ছিল যে, একদিকে তিনি প্রবল প্রতাপে জনসাধারণের রাজনীতি করছেন, অন্যদিকে নিজের দার্শনিক চিন্তা দিয়ে ভারতের মতো বিশাল একটি দেশের ভবিষ্যত বদলে দিয়েছেন। তার প্রজ্ঞা ও চিন্তার প্রভাব ভারতের শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের মধ্যেও গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু ও সরদার প্যাটেলের মতো নেতারা তার চিন্তা ও নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত ছিলেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতি মুগ্ধ হয়ে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন—‘মাওলানা আজাদের মতো সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন, উদারমনস্ক ও দূরদর্শী মানুষ ভারতীয় রাজনীতিতে বিরল।’ আমরা এখানে সেই মহান ব্যক্তিত্বের জীবন সম্পর্কে খানিকটা আলোচনা করবো।

জন্ম ও শৈশব
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ১৮৮৮ সালের ১১ নভেম্বর পবিত্র নগরী মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম ছিল আবুল কালাম গুলাম মুহিউদ্দিন। পূর্বপুরুষেরা ছিলেন আফগানিস্তানের হেরাত শহরের অধিবাসী—বাবরের আমলে তারা ভারতে এসে আগ্রা ও দিল্লিতে বসতি স্থাপন করেন। পিতা মাওলানা খায়েরউদ্দিন ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলেম, যিনি ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের সময় ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখে মক্কায় চলে যান এবং সেখানে স্থায়ী হন। মক্কায় তিনি শেখ মুহাম্মদ জাহের ওয়াতরির কন্যার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই ঘরেই মাওলানা আজাদের জন্ম। মাত্র দুই বছর বয়সে পিতা তাকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। এখানেই আজাদের শৈশব কাটে।

শিক্ষা
মাওলানা আজাদের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ঘরোয়া পরিবেশে। তার পিতা যেহেতু আলেম ছিলেন, তার কাছেই পড়াশোনা শুরু হয়। এরপর গৃহশিক্ষকদের কাছ থেকে তিনি কোরআন, হাদিস, ফিকহ ও আরবি ব্যাকরণ অধ্যয়ন করেন। পরে ফারসি, দর্শন, জ্যামিতি ও গণিতেও পারদর্শী হন। কৈশোরেই তিনি আলেম ও পণ্ডিতদের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় অংশ নিতেন, এবং তার তীক্ষ্ণ যুক্তি ও ভাষাশৈলীতে সকলকে মুগ্ধ করতেন। ইংরেজি ও পাশ্চাত্য দর্শনের জগৎ সম্পর্কে আগ্রহ জন্মায় তার আত্মশিক্ষার মাধ্যমেই। তিনি নিজ প্রচেষ্টায় ইংরেজি ভাষা, বিশ্ব ইতিহাস ও রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হন। তরুণ বয়সে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের আধুনিক চিন্তা ও জামালুদ্দিন আফগানির প্যান-ইসলামি ভাবধারা তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এর ফলে তার চিন্তার পরিধি বৃদ্ধি পায়, এবং তিনি উপলব্ধি করেন যে জ্ঞানের প্রকৃত উদ্দেশ্য মনের মুক্তি। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি নিজের নামের শেষে যুক্ত করেন ‘আজাদ’, অর্থাৎ মুক্ত শব্দটি যোগ করেন।


বিশ্বভ্রমণ
মাওলানা আজাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল ১৯০৮ সালে তার তরুণ বয়সের বিশ্বভ্রমণ। জ্ঞানের প্রতি গভীর তৃষ্ণা ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিপক্বতার জন্য তিনি আফগানিস্তান, ইরাক, মিশর, সিরিয়া ও তুরস্ক সফর করেন। এই সফর তার চিন্তাকে বদলে দেয়, দৃষ্টিকে আরও প্রসারিত করে।
লেখালেখি ও সাংবাদিকতার শুরু

কৈশোর থেকেই লেখালেখির সঙ্গে মাওলানা আজাদের সম্পর্ক। তার প্রথম লেখা ছাপা হয় মাত্র এগারো বছর বয়সে, আর চৌদ্দ বছর বয়সে ‘মাখজান’ পত্রিকায় তার গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশ পায়। ১৯০৩ সালে তিনি ‘লিসানুস সিদক’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। বিশ্বভ্রমণ থেকে ফিরে তিনি উপলব্ধি করেন—আমার হাতে এখন কেবল একটি অস্ত্রই আছে, আর তা হলো ‘কলম’। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহাসিক ‘আল-হিলাল’। এর মাধ্যমে তিনি ভারতের মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগিয়ে তোলেন, একই সাথে হিন্দু-মুসলিম এক হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। এক সময় ‘আল-হিলাল’ পত্রিকা ব্রিটিশদের চোখে কাঁটা হয়ে ওঠে। ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ সরকার সেটি বন্ধ করে দেয়। তখন তিনি ‘আল-বালাগ’ নামে নতুন পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন, কিন্তু তাও ১৯১৬ সালে বন্ধ হয়ে যায়।

খেলাফত আন্দোলন
ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপে তুরস্কের খেলাফত বিলুপ্তের কার্যক্রম শুরু হলে ১৯১৯ সালে মাওলানা আজাদ এর প্রতিবাদে আওয়াজ তোলেন। এই আন্দোলন মুসলিম উম্মাহর ঐক্য রক্ষার লক্ষ্যে শুরু হলেও মাওলানা আজাদ এটিকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারায় রূপ দেন। তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা ও প্রবন্ধ মুসলিম সমাজে রাজনৈতিক চেতনা ও ঐক্যের নবজাগরণ ঘটায়।


অহিংস আন্দোলন ও কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ
১৯১৯ সালে ব্রিটিশদের অন্যায় রাওলাট অ্যাক্ট ও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ভারতের জনমনে ক্ষোভের আগুন জ্বালায়। এই সময় মাওলানা আজাদ মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ ও অহিংস আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে কংগ্রেসের ঐক্য গড়ে তিনি হিন্দু-মুসলিম একতার নতুন অধ্যায় রচনা করেন। ১৯২০ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া খেলাফত কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং দেশব্যাপী ব্রিটিশবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন। ১৯২৩ সালে মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি কংগ্রেসের সর্বকনিষ্ঠ সভাপতি হন—অহিংস সংগ্রামের এই অধ্যায়ে তার নেতৃত্বই স্বাধীন ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি স্থাপন করে।

দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতা
যখন হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য আলাদা দুটো রাষ্ট্রের প্রস্তাব আসে, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ দৃঢ় কণ্ঠে তার বিরোধিতা করেন। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের বিকল্প হিসেবে তিনি প্রস্তাব দেন—একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতব্যবস্থা, যেখানে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে, আর প্রদেশগুলো পাবে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। এই পরিকল্পনায় মহাত্মা গান্ধীও সমর্থন জানান। মাওলানা আজাদের এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে ভারতের ইতিহাস আজ নিঃসন্দেহে ভিন্ন হতো।

স্বাধীনতার পরে মাওলানা আজাদ
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর মাওলানা আজাদ ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। শিক্ষা ও সংস্কারকে তিনি জাতির পুনর্গঠনের মূল চাবিকাঠি মনে করতেন। তার উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন (UGC), ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (IIT), এবং সাহিত্য আকাদেমি। তিনি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা গঠনে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। তার লক্ষ্য ছিল—একটি জ্ঞাননির্ভর, উদারচিন্তার ভারত, যেখানে শিক্ষা শুধু পেশা নয়, বরং চরিত্র গঠনেরও মাধ্যম হবে। জাতি গঠনে তার অবদানের কারণে আজও ভারত সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য হয়, নয়তো সেখানে কেবল হিন্দুত্ববাদই টিকে থাকত।

ইন্তেকাল
১৯৫৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ভারতের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে তাকে মরণোত্তর ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তার জন্মদিন, ১১ নভেম্বর, আজও সারা ভারতে জাতীয় শিক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার