সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে যেভাবে দুমড়ে-মুচড়ে গেল সোনায় সমৃদ্ধ ঘানা

জাগো বাংলা ডেস্ক প্রকাশিত: ০৯:৩৭ এএম, ০২ জানুয়ারি ২০২৩
সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে যেভাবে দুমড়ে-মুচড়ে গেল সোনায় সমৃদ্ধ ঘানা

পূর্ব আফ্রিকার দেশ ঘানার অর্থনীতি ২০১৯ সাল থেকে তর তর করে উপরের দিকে উঠছিল। ওই সময় ঘানাকে রাইজিং স্টার হিসেবে অভিহিত করেছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু মাত্র চার বছর যেতে না যেতে এখন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে আছে প্রাকৃতিক সম্পদ সোনায় সমৃদ্ধ ঘানা।

কেন এমনটি হলো? সম্ভাবনাময় ঘানা কেন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে? এ জন্য দায়ী মূলত দেশটির সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনার অভাব।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা ঘানার বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে দেশটির বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলেন দোরিস ওদোরো নামে ঘানার এক নারী। তার স্বামী নেই। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত খাদ্য পণ্যের একটি দোকান চালিয়ে দুই সন্তানসহ নিজের সংসার চালান। তিনি জানিয়েছেন, ক্ষতি ও খরচ কুলিয়ে উঠতে না পারায় দোকানটি আর চালানো সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেছেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলছে। আর এটি আমার মূলধন কমিয়ে দিচ্ছে। আমি দোকান বন্ধ করে দিতে চাই। অন্য কিছু করার চেষ্টা করব। আমি ব্যবসার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারছি না। আমার একটি পরিবার চালাতে হয়।’

মাত্র ৪ বছর আগে অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব উত্থান দেখে ঘানা। তখন বিশ্বব্যাংক দেশটিকে অর্থনীতির উদীয়মান নক্ষত্রের তকমাও দেয়। ২০১৯ সালে ঘানার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আর দেশটিকে আফ্রিকার পোস্টার বয় হিসেবে অভিহিত করা হয় না। অথচ ঘানা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কোকোয়া ও সোনা উৎপাদনকারী দেশ।

বর্তমানে নিজেদের অর্থনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃসময় পার করছে দেশটি। মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৫০.৩ শতাংশ ছুঁয়েছে। গত ২১ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।

২০১৭ সালে ঘানার ক্ষমতায় আসেন প্রেসিডেন্ট নানা আকুফো-আদ্দো। তিনি এসেই মুদ্রাস্ফীতি কমাতে সমর্থ হন। ২০১৬ সালে তার আগের সরকারের আমলে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১৫.৪ ভাগ। নতুন প্রেসিডেন্ট আকুফো-আদ্দো ২০১৯ সালের মধ্যে তা ৭.৯ ভাগে কমিয়ে আনেন। ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস হানা দেওয়ার আগ পর্যন্ত এটি এক ডিজিটেই ছিল। এছাড়া বাজেট ঘাটতিও কমিয়ে আনেন তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে তার কিছু ভুল সিদ্ধান্ত সবকিছু নস্যাৎ করে দিয়েছে।

ঘানার প্রেসিডেন্ট নানা আকুফো-আদ্দো
ঘানাভিত্তিক অর্থনৈতিক সংস্থা পলিসি ইনিশিয়েটিভ ফর ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্টের অর্থনীতিবিদ অনিম আমারতায়ে বলেছেন, ‘২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমরা যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখেছি সেগুলো আসলে তেল খাত থেকে এসেছিল। আমরা খুবই খুশি ছিলাম কারণ প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। কিন্তু অর্থনীতির অন্যান্য খাতে আমরা তা ছড়িয়ে দিতে পারিনি।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা সরাসরি কৃষিখাতকে অবহেলা করেছি। এ খাতে শক্তিশালী কোনো বিনিয়োগ করতে পারিনি। সরকার আত্মতুষ্টিতে ভুগছিল।’

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী খাদ্য ও কৃষি প্রতিষ্ঠানগুলো ঘানার মোট জিডিপির ২১ ভাগ এবং রপ্তানি আয়ের প্রায় ৪০ ভাগ যোগান দেয়। এছাড়া নিজ উৎপাদিত কৃষি পণ্যের মাধ্যমে ঘানা নিজ দেশের ৯০ ভাগ মানুষের চাহিদা মেটায়।

সরকারের আরও কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ঘানায় এখন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আল জাজিরা। যদিও ঘানার সরকার এখন দাবি করছে করোনা মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এমনটি হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক দুরাবস্থার জন্য শুধুমাত্র এগুলোই দায়ী না। সরকারের কিছু অদূরদর্শী সিদ্ধান্তও রয়েছে।

ঘানার প্রেসিডেন্ট আকুফো-আদ্দো ক্ষমতায় এসে হাইস্কুলে বিনামূল্যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সবার জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকা ১৭ দশমিক ৫ ভাগ কর, আবাসন এবং নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের ওপর থাকা কর তুলে দেন। অন্যদিকে গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ, অভ্যন্তরীণ বিমানের ওপর আরোপিত করের পরিমাণ কমিয়ে দেন। যেগুলো একদিকে সরকারের ব্যয় বাড়িয়ে দেয় অন্যদিকে রাজস্ব আশঙ্কাজনক হারে কমিয়ে দেয়।

মিশিগানের অ্যান্ড্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক উইলিয়াম কাওয়াসি পেপরাহ বলেছেন, ‘রাজস্ব কমে যাওয়ায় সরকার ঋণ নেওয়া শুরু করে। এতে করে ঘানার অভ্যন্তরে এবং বাইরে বন্ডের কার্যক্রম বেড়ে যায়। যেটির কারণে বর্তমানে ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।’

এই অধ্যাপক আরও জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পদক্ষেপ নেন। এতে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৩ থেকে ২৪-এ নেমে যায়। এ বিষয়টিও অর্থনীতিকে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

এছাড়া ২০১৯ সালে দেশে আরও দুটি তেলক্ষেত্র পাওয়া যায়। এতে সরকার ভেবেছিল অর্থনীতিতে এগুলো গতিশীলতা আনবে। ফলে বাজারে বন্ড ছাড়া হয়। কিন্তু আসলে এসব বন্ড সরকারের ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

২০২০ সাল থেকেই মূলত অর্থনৈতিক দিক থেকে পেছনে যেতে থাকে ঘানা। ওই সময় পুরো বিশ্বের মতো ঘানাতেও করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ায় লকডাউন আরোপ করা হয়। লকডাউনে সরকার বিনামূল্যে বিদ্যুৎ ও পানি দেওয়ার পাশাপাশি ৪ লাখ ৭০ হাজার পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করে। যার জন্য প্রায় ৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়।

২০২১ সালের আগস্ট মাসে ১ বিলিয়ন ডলারে ১১১টি হাসপাতাল তৈরির একটি প্রজেক্ট হাতে নেন প্রেসিডেন্ট। যা পরবর্তীতে একটি ভুল পদক্ষেপ হিসেবে প্রমাণিত হয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট নিজেও এটি স্বীকার করে নেন। এছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করবে এমন বিষয়গুলোর ওপর অর্থ খরচ না করে রাস্তা, স্কুলসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এতে সরকারের ঋণ আরও বাড়ে।

তেল বিক্রি করে ঘানা ভালো পরিমাণ একটি অর্থ আয় করলেও ঋণ শোধ করতে সেটি চলে যায়।

করোনা মহামারীর ধাক্কা সামলে ওঠে ঘানা যখন একট ঘুরে দাঁড়ানোর অবস্থায় এসেছিল তখনই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ বাঁধে। এর প্রভাবে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কানাডার মুদ্রা সেডির মূল্য প্রায় অর্ধেক কমে যায়। এমন পরিস্থিতিতে এখন ঘানায় বিদেশিরা বিনিয়োগ করতেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

সূত্র: আল জাজিরা