নিউইয়র্কের এত ইহুদি কেন জোহরান মামদানিকে সমর্থন দিচ্ছেন?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:১৫ পিএম
ইসরাইলের বাইরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইহুদির বসবাস যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরে। প্রায় ১০ লাখ ইহুদির আবাসস্থল এই মহানগর।
জাতিগত, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় এই সম্প্রদায়কে কোনো রাজনৈতিক প্রতিনিধিই উপেক্ষা করতে পারেন না।
আগামী ৪ নভেম্বর নিউইয়র্ক নগরের মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী নির্বাচনের প্রাইমারিতে ৪৪ বছরের নিচের ৬৭ শতাংশ ইহুদির ভোট পেয়েছিলেন জোহরান মামদানি। জরিপ অনুযায়ী, সামগ্রিকভাবে তিনি মোট ৪৩ শতাংশ ইহুদির ভোট পেয়েছিলেন।
জোহরান মামদানিকে নিয়মিতভাবে ইহুদিবিদ্বেষী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এরপরও ডেমোক্রেটিক পার্টির এই মেয়র প্রার্থী ইহুদিদের ব্যাপক সমর্থন আদায় করে নিয়েছেন। তার পক্ষে প্রচারের জন্য ইহুদি–সমর্থকদের একটি অংশ ‘জিউশ ফর জোহরান’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে।
জ্যাকব ব্লুমফিল্ড হাজারো প্রচারকর্মীর সঙ্গে রাস্তায় নেমে জোহরানের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, সমাজের সবারই বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবহন, পুষ্টিকর খাবার ও নিরাপত্তার মতো মৌলিক অধিকার পাওয়া উচিত। কিন্তু স্থিতিশীল জীবনের জন্য এই উপাদানগুলো এখন অনেকের নাগালের বাইরে।
ব্লুমফিল্ড বলেন, এমনকি ৩০ বছর আগে যাদের মধ্যবিত্ত ধরা হতো, তারাও আজ টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছেন। এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। জোহরান একমাত্র প্রার্থী, যিনি এ পরিস্থিতির গভীরতা ও করুণ বাস্তবতা নিয়ে সত্যিই ভাবছেন।
জোহরানের এই ইহুদি–সমর্থক বলেন, তিনি নির্বাচনী প্রচারে নেমেছেন। কারণ, মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলা এবং ধারণা বিনিময় করা রাজনীতির সবচেয়ে মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁর মতে, তরুণ ইহুদিরা জোহরানকে সমর্থন করছেন। কারণ, তারা মনে করেন, ইসরাইল তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা বরং নিউইয়র্কে টিকে থাকার সংগ্রাম নিয়েই বেশি চিন্তিত।
‘আমি তার নীতিগুলো ভালোবাসি’
অভিনেতা ও কৌতুকশিল্পী ম্যাট কেটাইও (৩৬) জোহরান মামদানির নির্বাচনী প্রচারে নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমি জোহরানের ব্যক্তিত্বে বিশ্বাস করি। আমি তার নীতিগুলোকে ভালোবাসি, তার ভাবনাকে ভালোবাসি। তিনি প্রাণবন্ত ও উদ্যমী। তিনি সত্যিই নিউইয়র্ককে ভালোবাসেন এবং এই শহরকে আরও ভালো জায়গায় পরিণত করতে চান। অন্য কোনো রাজনীতিকের মধ্যে আমি এটা দেখি না।’
নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর ও স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুমো ও অন্যরা জোহরানকে নিয়ে ইসলামবিরোধী যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন এবং তাকে ইহুদিবিদ্বেষী বলে যে প্রচার চালাচ্ছেন, তাতে উদ্বিগ্ন ম্যাট।
ম্যাট বলেন, ‘যেভাবে ইসলামোফোবিয়া ছড়ানো হচ্ছে এবং ইহুদিবিদ্বেষের মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তাতে একজন ইহুদি হিসেবে আমি কম নিরাপদ বোধ করছি।’
জোহরানের এই ইহুদি–সমর্থক আরও বলেন, ‘মুসলিন ও ইহুদিদের নিরাপত্তা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। আমি বিশ্বাস করি, জোহরান এমন অনেক কিছু করবেন, যা ইহুদি সমাজসহ পুরো নিউইয়র্কের জন্যই ভালো হবে এবং আমাদের নিরাপদ বোধ করাবে।’
নিউইয়র্কের সাংবাদিক ক্যালেব এসপিরিতু-ব্লুমফিল্ডও জোহরানের উদ্যমী মনোভাবের কারণে তাঁকে সমর্থন দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এবার সেই উদ্দীপনা টের পাচ্ছি, যা বারাক ওবামার উত্থানের সময় পেয়েছিলাম।’
জোহরান বাড়িভাড়া স্থগিত করা কিংবা বিনা মূল্যে বাস চালু করার মতো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না বলে মনে করেন ওই সাংবাদিক। তবে তার বিশ্বাস, জোহরান সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। কারণ, জাতি-ধর্মনির্বিশেষে নিউইয়র্কের মানুষ কী চান, তা তিনি জানেন।
এসপিরিতু-ব্লুমফিল্ড বলেন, ইসরাইল ইস্যু নিয়ে প্রজন্মগত বিভাজনই জোহরানের প্রতি ইহুদি–সমর্থনের অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, বয়স্ক ইহুদিরা ইসরাইলকে তাদের নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে দেখেন। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো কঠিন।
এই সাংবাদিক বলেন, ‘আমি জোহরানকে কখনোই সরাসরি ইসরাইলবিরোধী বলব না। মজার বিষয় হলো, এ মন্তব্য জায়নবাদী ও জায়নবাদবিরোধী—উভয় পক্ষকেই ক্ষুব্ধ করবে। কারণ, জায়নবাদীরা তাঁকে শত্রু মনে করেন। আর জায়নবাদবিরোধীরা তাঁকে নিজেদেরই একজন বলে বিশ্বাস করেন।’
এসপিরিতু-ব্লুমফিল্ড আরও বলেন, ইসরাইলের প্রসঙ্গ এলে সাবেক গভর্নর কুমো এমন আচরণ করেন, যেন তিনি নিজেই ইহুদি, ইহুদিদের রাজা। আসলে তিনি তা নন।
এসপিরিটু-ব্লুমফিল্ড বলেন, তিনি সান্ত্বনা পান এই ভেবে যে জোহরান একজন মুসলিম। কারণ, ইহুদিধর্ম ও ইসলাম একই শিকড় থেকে এসেছে। দুটিই সেমিটিক। দুই ধর্মের ভাষার মধ্যেও মিল পাওয়া যায়, খাবারের ধরনও কাছাকাছি। এমনকি ইহুদিধর্মের অনেক নীতিই ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের সঙ্গে বিস্ময়করভাবে মিলে যায়।
এসপিরিটু-ব্লুমফিল্ড বলেন, ‘দিন শেষে আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, সব ইহুদিই জোহরান মামদানির নিউইয়র্ক নিয়ে ভবিষ্যৎ ভাবনার অংশ।’
সংখ্যালঘুদের সংহতি
ম্যানহাটানের ৬৬ বছর বয়সি এক ইহুদি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইহুদি সমাজের ভেতরে এখন ভয়াবহ বিভাজন দেখা দিয়েছে। একদিকে ইসরাইল নিয়ে বিভাজন, অন্যদিকে জোহরান মামদানিকে নিয়ে।
এই ব্যক্তি বলেন, নিউইয়র্কের প্রার্থী নির্বাচনে তিনি ব্র্যাড ল্যান্ডারকে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সাধারণ নির্বাচনে জোহরানকে সমর্থন দিচ্ছেন। এ কারণে তাকে নানা রকম সমালোচনার মুখেও পড়তে হচ্ছে।
এই ব্যক্তি আরও বলেন, ‘জোহরানকে সমর্থন করায় আমাকে অনেক নোংরা কথা শুনতে হয়েছে। আমি একটি অভিজাত সিনাগগে গিয়েছিলাম। সেখানে লোকেদের বলতে শুনেছি, তারা আর নিরাপদ বোধ করছেন না। তাদের নাকি শহর ছেড়ে দিতে হবে, অথচ তারা লাখ লাখ ডলার মূল্যের বাড়িতে থাকেন।’
জোহরানের এই সমর্থক বলেন, ‘আমাদের সমাজে নগ্নভাবে ইসলামবিদ্বেষ ঢুকে পড়েছে। এটি আমাদের মূল্যবোধের পরিপন্থি। এ কারণে অনেক ইহুদি ক্ষুব্ধ।’
জোহরানের এই ইহুদি সমর্থক আরও বলেন, অনেক ইহুদি জোহরান মামদানিকে ভোট দেবেন, কিন্তু তারা চুপচাপ আছেন। কারণ, এ বিষয়ে কথা বললেই ঝামেলা। তিনি ৪ নভেম্বরের নির্বাচনে জোহরানের জয় নিয়ে আশাবাদী।